টাঙ্গাইলের তিন উপজেলায় ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন প্রার্থীরা

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি প্রকাশিত: মে ১৮, ২০২৪, ০৬:৩১ পিএম
টাঙ্গাইলের তিন উপজেলায় ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন প্রার্থীরা

৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জেলার এ তিন উপজেলায় আগামী ২১ মে (মঙ্গলবার) ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

নির্বাচনি প্রচারণার শেষ মুহূর্তে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীরা নানা প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভোটারদের মন জয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটছেন প্রার্থীরা।

পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে উপজেলা শহর, গ্রামের হাট-বাজার, অলিগলিসহ বিভিন্ন এলাকা ও পথ-প্রান্তর। প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা প্রতিদিনই গণসংযোগের পাশাপাশি উঠান বৈঠক ও পথসভা করছেন। এক কথায় জমজমাট হয়ে উঠেছে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনি প্রচারণা।

প্রচারণাকালে তিনটি উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীরা একে-অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন। এক প্রার্থী অপর প্রতিদ্বন্দ্বির আমলনানা তুলে ধরে ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে কয়েক প্রার্থীকে জরিমানাও গুণতে হয়েছে।

১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ঘাটাইল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি লোকমান হোসেন (মোটরসাইকেল) ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মুহাম্মদ আরিফ হোসেন (আনারস) প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

লোকমান হোসেনের পক্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দলবদ্ধ হয়ে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। অপরদিকে, আরিফ হোসেনের পক্ষে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমর্থন রয়েছে। ফলে এ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।

ভাইস চেয়ারম্যান পদে ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সদ্য সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কাজী আরজু (তালা), আতিকুর রহমান (চশমা), বিএনপি পরিবার থেকে আব্দুস ছালাম খান আওয়াল (টিউবওয়েল) প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে সদ্য সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহীনা সুলতানা শিল্পী (সেলাই মেশিন), বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত উপজেলা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক তাসলিমা জেসমিন পাপিয়া (প্রজাপতি) এবং সাবেক ইউপি সদস্য নাজমুন নাহার নাজমা (কলসি) প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

এ উপজেলায় মোট ভোটার তিন লাখ ৬০ হাজার ৭৮১ জন। এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৮১ হাজার ২৬৫ জন এবং মহিলা এক লাখ ৭৯ হাজার ৫১৪ জন। ১২০টি কেন্দ্রের ৮৭১টি কক্ষে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

কালিহাতী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মূলত আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে সিদ্দিকী পরিবার আবির্ভূত হয়েছে। জম্পেশ লড়াই চলছে প্রচারণার মাঠে। টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে আলোচিত সিদ্দিকী পরিবারের ভাইদের ছোটজন করটিয়া সা’দত কলেজের সাবেক ভিপি শামীম আল মনসুর (এসএএম) সিদ্দিকী ওরফে আজাদ সিদ্দিকী (আনারস) এবং আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মোল্লার (মোটরসাইকেল) নির্বাচনি লড়াই ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।

এ উপজেলায় বাংড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হাসমত আলী নেতা (দোয়াত কলম) চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী থাকলেও তেমন প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।

আজাদ সিদ্দিকীর (আনারস) পক্ষে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বেশ কয়েকটি এলাকায় নির্বাচনি সভায় অংশ নিয়ে ভাইয়ের জন্য ভোট চেয়েছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সাবেক সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী বড় ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী স্থানীয় সংসদ সদস্য হওয়ার কারণে নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ না নিলেও ছোটভাই আজাদ সিদ্দিকীর প্রতি সমর্থন রয়েছে বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন।

উপজেলার রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, সিদ্দিকী পরিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো কালিহাতী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিজয়ী হয়ে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান আরও সুসংহত করতে চাইছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সিদ্দিকী পরিবারের আধিপত্য রোধ করতে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে।

কালিহাতীর রাজনীতিতে সিদ্দিকী পরিবারের বিশাল প্রভাব রয়েছে। এই পরিবারের বড় ছেলে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী কালিহাতী থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে পাঁচবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। তার স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন।

২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিত্ব পান। আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য পদ লাভ করেন। ২০১৪ সালে বিদেশে হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার ও মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা হয়।

লতিফ সিদ্দিকী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তার পাশে ছিলেন ছোট ভাই কাদের সিদ্দিকী ও আজাদ সিদ্দিকী। এবার আজাদ সিদ্দিকী তার বড় দুই ভাইয়ের সমর্থন নিয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। লতিফ সিদ্দিকী সরাসরি নির্বাচনের মাঠে না নামলেও নেপথ্যে থেকে ভাইয়ের জন্য কাজ করছেন। কাদের সিদ্দিকী একাধিক দিন কালিহাতীর বিভিন্ন এলাকায় ছোট ভাইয়ের পক্ষে গণসংযোগ করেছেন।

আজাদ সিদ্দিকী জানান, কালিহাতীর প্রতিটি এলাকার ভোটারদের কাছ থেকে তিনি ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। প্রতিটি এলাকার মানুষ তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। ‘নিজের খেয়ে’তার নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে তিনি বিজয়ী হওয়ার আশা রাখেন।

অপরদিকে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মোল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ করছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পক্ষের নেতারা তার নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। সাবেক সংসদ সদস্য হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মোজহারুল ইসলাম তালুকদার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনসার আলী, জেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক আবু নাসেরসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা আনোয়ার মোল্লাকে বিজয়ী করতে কাজ করছেন।

আনোয়ার হোসেন মোল্লা জানান, নির্বাচনে তিনি দ্বিধা বিভক্ত আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মীকে এক প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন- এটাও তার জন্য এক প্রকার বিজয়। তিনি উপজেলার জনগণের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মানুষের সুখে-দু:খে পাশে আছেন। এজন্য ভোটাররা তাকেই নির্বাচিত করবে।  
এ উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন ও সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হচ্ছেন- উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মো. আখতারুজ্জামান (টিউবওয়েল), মো. আব্দুল্যাহ সরকার (চশমা), মো. আব্দুল বারেক সরকার (উড়োজাহাজ), মো. মাহমুদুল হাসান দীপুল (তালা) ও জমীর উদ্দিন আমেরী (বই)।

সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপজেলা পরিষদের বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রীনা পারভীন (প্রজাপতি) ও উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ফাতেমা খাতুন বৃষ্টি (ফুটবল)।

১৩টি ইউনিয়ন ও দুইটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত কালিহাতী উপজেলায় মোট ভোটার তিন লাখ ১২ হাজার ১১২ জন। এরমধ্যে পুরুষ এক লাখ ৫৫ হাজার ৪০৫ জন এবং মহিলা এক লাখ ৫৬ হাজার ৭০৭ জন।

ভূঞাপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও গত ৮ মে থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ভূঞাপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম তালুকদার বিদ্যুৎ (মোটরসাইকেল) ও উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক তাহেরুল ইসলাম তোতা (আনারস) নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।

অপর তিন প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী ভোটারদের দ্বারে দ্বারে নানা কৌশলে ভোট প্রার্থনা করছেন। তারা হচ্ছেন- বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা মহিলা লীগ নেত্রী মোছা. নার্গিস বেগম (দোয়াত কলম), আওয়ামী লীগ নেতা মো. ফিরোজ চৌধুরী (হেলিকপ্টার) ও উপজেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার বাবলু (ঘোড়া)।

উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, তৃণমূলের আওয়ামী লীগ নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধারা মোছা. নার্গিস বেগমকে সমর্থন দেওয়ায় তিনি প্রায় ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন। তারপরও তার প্রচারণা থেমে নেই। আওয়ামী লীগ নেতা মো. ফিরোজ চৌধুরী হেলিকপ্টার প্রতীক নিয়ে পৌরসভাসহ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়াচ্ছেন।

উপজেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার বাবলু ঘোড়া প্রতীকে প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ায় তার জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পরলেও ভোটারদের কাছে তিনি প্রিয়পাত্র।

ভূঞাপুর উপজেলায় পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদে খোরশেদ আলম (টিয়া পাখি), ওয়াজেদ আলী খান (মাইক), আরিফুল হক (টিউবওয়েল) ও মনিরুল ইসলাম (তালা) এবং সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে আলিফ নুর (প্রজাপতি), মঞ্জুয়ারা বেগম (পদ্মফুল), সাদিয়া আফরিন খানম (ফুটবল) ও হোসনে আরা বেবী (কলসি) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

৬টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ভূঞাপুর উপজেলায় মোট ভোটার এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৬৯ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৮৪ হাজার ৬৯১জন ও মহিলা ভোটার ৮২ হাজার ১৭৮জন।

ইএইচ