ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড উপকূলীয় জেলা বরগুনা

বেলাল হোসেন মিলন, বরগুনা প্রকাশিত: মে ২৮, ২০২৪, ০৪:৩০ পিএম
ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড উপকূলীয় জেলা বরগুনা
  • তিন শতাধিক গ্রাম প্লাবিত
  • একজনের মৃত্যু, আহত অর্ধশত
  • খোলা আকাশের নিচে অসংখ্য মানুষ

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে লন্ডভন্ড হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা বরগুনা। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, মাছের ঘের ও বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গাছপালা উপড়ে গেছে।

অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর থেকেই বিদ্যুৎ গ্রামাঞ্চলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শহরের কিছু স্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হলেও জেলার ছয়টি উপজেলার কয়েক লক্ষাধিক মানুষ বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে। সবকিছু সচল করতে মাঠে কাজ করছে প্রশাসন। রেমালে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হাজারো পরিবারের সদস্যরা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে।

ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে বরগুনায় অন্তত ১৬ হাজার ৪০৮টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজার ৩৭৪টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ১৩ হাজার ৩৪টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সদরের আয়লাপাতাকাটা ইউনিয়নের লেমুয়া গ্রামের আব্দুর রহিম বয়াতি নামাক এক ব্যক্তি গাছচাপায় নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত। জলোচ্ছ্বাসে বন্যাদুর্গত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই লাখ ৩১ হাজার ৭০০ মানুষ। বরগুনা জেলা প্রশাসন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রেমালের আঘাতের পর জেলার প্রধান তিন নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ ফুট উচ্চতার জোয়ার প্রবাহিত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে পায়রা ও বিষখালী নদী তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ১২ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৬ হাজার হেক্টর কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডুবে গেছে চার ১৫৭ হেক্টর মাছের ঘের ও উন্মুক্ত জলাশয়। পানিবন্দি আছে কয়েক হাজার মানুষ। দুর্ভোগে পড়েছে তারা। এছাড়া জেলার দুটি ফেরিঘাট ডুবে গেছে।

গাছপালা ভেঙে ও ঘরবাড়িতে চাপা পড়ে অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। কেউ নিখোঁজ হয়নি। সোমবার রাত ১০টা পর্যন্ত শহর এবং উপকূলীয় এলাকায় দমকা হাওয়াসহ মাঝারি ও ভারী বৃষ্টি অব্যাহত ছিল। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আকাশ মেঘলা ছিল। হালকা বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে।

পায়রা ও বিষখালী নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোববার সন্ধ্যার পর থেকে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি বাড়তে থাকে। স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় পানি বেড়ে যায়। রাতে নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকতে শুরু করে। সকালে প্লাবিত হয় সড়ক ও মাছের ঘের। ডুবে যায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

জেলা প্রশাসন জানায়, রেমালের তাণ্ডবে পায়রা ও বিষখালী নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোর ওপর দিয়ে ৯ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস বয়ে গেছে। প্লাবিত হয়েছে ৩০০টি গ্রাম। বিভিন্ন উপজেলায় তিন হাজারের বেশি গাছপালা উপড়ে পড়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে ১৬ হাজার ৪০৮টি বাড়িঘর। বন্যাদুর্গত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই লাখ ৩১ হাজার ৭০০ মানুষ। অধিকাংশ উপজেলা বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। গাছপালা পড়ে ৩৭ জন আহত হয়েছেন।

এ ব্যাপারে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে অধিকাংশ স্থানে খুঁটি ও গাছপালা ভেঙে পড়ায় পুরো জেলায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। ফলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় এখন পর্যন্ত ১৬ হাজার ৪০৮টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কমবেশি দুই লাখ ৩১ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তথ্য সংগ্রহের কাজ এখনও চলমান আছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। আমরা এখনও উপকূলীয় এলাকাগুলোর তথ্য সংগ্রহ করছি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বরগুনা কার্যালয়ের কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাকিব বলেন, বরগুনা সদরের ডালভাঙ্গা, লতাবাড়িয়া, মোল্লারহোরা, মাঝখালী, আয়লা, পাতাকাটা, আমতলী উপজেলা, আরপাঙ্গাশিয়া, তেঁতুলবাড়িয়া এবং পাথরঘাটার কাকচিড়া, রুহিতা, জিনতলা, চরলাঠীমারা, কাঁঠালতলী, চরদুয়ানি পদ্মা এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে এসব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ দ্রুত মেরামত করা হবে।’

নদীতে ৯ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল উল্লেখ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বরগুনা কার্যালয়ের পানি পরিমাপক খাইরুল ইসলাম বলেন, রোববার রাতে সর্বোচ্চ ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল। পরে নদীতে ভাটা শুরু হলে পানি নেমে যায়। এখনও বেশিরভাগ এলাকার মানুষজন পানিবন্দি আছেন।

বরগুনা সদর থানার ওসি একেএম মিজানুর রহমান বলেন, থানার ভেতরে হাঁটুসমান পানি। শহরের রাস্তাঘাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। বিভিন্ন এলাকায় গাছ উপড়ে পড়েছে। মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

বড়ইতলা ফেরিঘাট, ডালভাঙা, ঢলুয়া, পুরাকাটা, আয়লা-পাতাকাটা বালিয়া তলিসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রোববার থেকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে জেলার বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। গাছ পরে বসতঘর ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও সড়কে যানবাহন বন্ধ এবং নেটওয়ার্ক সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় জেলার সঙ্গে ছয় উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

ইএইচ