ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, উপকূলীয় দ্বীপজেলা ভোলায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলা উপজেলার শহর রক্ষা বাঁধ,ফসলের মাঠ, পুকুরের মাছ, গবাদিপশু, পানিতে তলিয়ে গেছে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ,শহর রক্ষা বাঁধ ধসে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম,উপরে পড়েছে ছোট-বড় প্রায় কয়েক হাজার গাছপালা। ঘর চাপায় ও গাছের আঘাতে শিশু, নারী, পুরুষসহ সর্বমোট ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ২০ জন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে গত রোববার সকাল থেকেই শুরু হয় তীব্র বাতাস, এর সাথে বাড়তে থাকে নদীর পানি, দুপুরের মধ্যেই তলিয়ে যায় চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন ঢালচর ও কুকরি-মুকরি, বিকেলের দিকে নদীতে ভাটা শুরু হওয়ার সাথে পানির পরিমাণ কমতে শুরু করলেও গভীর রাতে বাতাসের গতিবেগ আরো বৃদ্ধি পেয়ে রাতভর চলতে থাকে ঘূর্ণিঝড় রিমাল এর তাণ্ডবলীলা। তীব্র বাতাসে জেলার সাত উপজেলায় প্রায় দুই ৫ /৭ হাজার বাড়ি ঘর বিধ্বস্ত হয়। উপরে পড়েছে সহস্রাধিক গাছপালা, অসংখ্য বিদ্যুতের খুঁটি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলা উপজেলার শহর রক্ষা বাঁধ,ফসলের মাঠ, পুকুরের মাছ সহ গবাদিপশু,এছাড়াও বিভিন্ন স্থানের জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ৩০ গ্রাম।
মঙ্গলবার (২৮ মে) সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় সদর উপজেলার রামদাসপূর, চটকিমারা,মাঝেরচর, বোরহানউদ্দিন উপজেলার গঙ্গাপুর, হাসান নগর পক্ষিয়া, দৌলতখান উপজেলার মদনপুর, সৈয়দপুর চরফ্যাশনের ঢালচর, চরকুকরি মুকরি, মনপুরা উপজেলার হাজির হাট, উঃ সাকুচিয়া, দঃ সাকুচিয়া, চরকলাতলী সহ অনেক এলাকায় বন্যার পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বহু এলাকার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দি হয়ে মানেেবতর জীবন যাপন করছেন। দুর্গত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ এখনো পৌঁছেনি।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানাগেছে ভোলা সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের মাঝির হাট এলাকার তোফাজ্জল হাজারির ছেলে ওমর ফারুক(৪০) সোমবার বিকাল ৫ টার সময় বসত ঘরে গাছ চাপায় এবং দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নে আবুল কাশেম নামে আরো ২জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে এর আগে একই দিনে দৌলতখাঁনে ঘরের ভেতর গাছ চাপা পড়ে মাইশা (৪) নামে এক শিশু,লালমোহনের চর উমেদ গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল কাদেরের স্ত্রী মনেজা খাতুন (৫০),বোরহানউদ্দিন উপজেলার সাচড়া ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের পঞ্চায়েত বাড়ির জাহাঙ্গীর পঞ্চায়েত নিহত হন এনিয়ে জেলায় মোট ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জানান,ঝড়ো বাতাসের কারণে এখন সব দিক থেকে খবর নেয়া সম্ভব হয়নি। ঝড় থেমে যাওয়ার পরে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হবে।
অপরদিকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরায় হাজিরহাটের পূর্ব পাশে চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) জিও ব্যাগ ফেলে বাঁধ রক্ষার জন্য বলা হয়েছে বলে জানায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম।
চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের ঢালচর ও চরনিজামে বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নেই। এ কারণে বাসিন্দারা ঘর ছেড়ে, গবাদিপশু রেখেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে।
ঢালচর ইউপি চেয়ারম্যান মো. আবদুস সালাম জানান, সকালের ৪/৫ ফুট জোয়ারের পানিতে ইউনিয়নের সব এলাকা তলিয়ে গেছে। ওই পানি কমতে না কমতে আবার রাতের জোয়ার আসবে। এখানে প্রায় ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশসহ ইউপি সদস্যদের মানুষের বাড়ি বাড়ি পাঠানো হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, ভোলা সদর,মনপুরা, লালমোহন, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলায় মোট ১০টি স্থানে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অচিরেই ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঘূর্ণিঝড়ে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের তারে গাছ পালা উপরে পড়ে বিদ্যুতের লাই ছিড়ে যায়। এতে করে গত রোববার সকাল থেকে বিদ্যুৎহীন রয়েছে পুরো জেলার মানুষ।
এ ব্যাপারে ভোলার বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ এর নির্বাহী প্রকৌশলী (ওজোপাডিকো) কাউসার আহমেদ বলেন,
বিভিন্ন উপজেলায় বিদ্যুতের সংযোগ লাইনে গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ঝড়ের মধ্যেও ওই সকল লাইনগুলো সংস্কারে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন মাঠে কাজ করে চাচ্ছেন। আমরা আশা করছি সন্ধ্যার পরপরই পর্যায়ক্রমে কিছু কিছু জায়গার বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করতে পারবো।
তাছাড়া টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে চলতি বোরো আবাদে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন জেলা কৃষি বিভাগ। ১ লাখ ৮০ হাজার হেক্টরে বোরো আবাদের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চাষীদের পাশাপাশি তারাও মাঠে কাজ করছেন। বর্তমান ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বড় একটি অংশ ক্ষতির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা করছেন জেলার কৃষি বিভাগ।
জেলা প্রশাসক মো.আরিফুজ্জামান জানান অতীতে যে সকল ঘূর্ণিঝড় হয়েছে সে সকল ঝড় অল্প সময়ের মধ্যে পরিবেশ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব টানা দুই দিন যাবত অব্যাহত ছিল তাই টানা দুই দিনের ঝড়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মানুষের জানমালসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা পর্যায়ক্রমে এ সকল ক্ষয়ক্ষতির তালিকা নিরূপণ করে প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে সরকারের পক্ষ থেকে যথা সম্ভব সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।
আরএস