নাব্যতা হারাচ্ছে হালদা নদী

মো. সাহাবুদ্দীন সাইফ, হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৪, ০১:২২ পিএম
নাব্যতা হারাচ্ছে হালদা নদী

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু মৎস্য হ্যারিটেজ হালদা নদীতে প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথি বা জোতে পরিবেশ অনুকূলে থাকলে অর্থাৎ প্রচণ্ড বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হলে রুই, কাতল, মৃগেল ও কালিবাউস তথা কার্প জাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়ে।

নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হলে পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা সৃষ্টি হয়, এমন পরিবেশে মা মাছ ডিম ছাড়ে। চৈত্র বৈশাখ মাস থেকে দেশের বিভিন্ন নদী থেকে কার্প জাতীয় মা মাছ হালদায় প্রবেশ করে। মা মাছ ডিম ছাড়ার ফলে তা হালদার দুপাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা তা সংগ্রহ করে হ্যাচারির পাকা কুয়া, ব্যক্তিগত মাটির কুয়ায় সংরক্ষণ করে ডিম থেকে রেণু উৎপাদন করে বাণিজ্যিকভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাছ চাষিদের উচ্চমূল্যে বিক্রি করেন।

এ মাছের আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বাদে অতুলনীয় এবং ওজন দ্রুত বৃদ্ধি, তাছাড়া এই মাছ অন্যান্য মাছের চাইতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও সহনশীলতা বেশি বলে জানা গেছে। রুইজাতীয় মাছের প্রকৃত বংশধরদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য হালদা নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিকল্প নাই। হালদা নদীকে চট্টগ্রামের ‘লাইফ লাইন’ বলা হয়। কারণ চট্টগ্রাম শহরে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ বসবাস করে। তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসা দিনরাত যে পানি সরবরাহ করে, তার মধ্যে প্রতিদিন ১৮ কোটি লিটার পানি এই হালদা নদী থেকে সংগ্রহ করা হয়।

চট্টগ্রাম শহরের একদিকে বঙ্গোপসাগর, একদিকে পাহাড় অন্যদিকে কর্ণফুলি নদী। তার মধ্যে একমাত্র ফ্রেশ ওয়াটার সোর্স হচ্ছে হালদা নদী। কোনো কারণে যদি হালদা নদী বিপন্ন হয়, তাহলে চট্টগ্রামের মানুষের জীবনযাত্রাই বিপন্ন হবে। আর সে হালদা নদীই তার নাব্যতা হারাচ্ছে বালু ভরাটের কারণে। হালদা নিয়ে সরকারি বেসরকারিভাবে প্রতিনিয়ত মাতামাতি থাকলেও খননে কোন উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেউ। অনেকের মতে এর পেছনে অদৃশ্য কোন কারণ রয়েছে।

অথচ হালদা পাড়ের বাসিন্দা, প্রকৃত ডিম সংগ্রহকারী, জনপ্রতিনিধি সবার একই মতামত হালদা খননে ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই হারিয়ে যাবে হালদার প্রাকৃতিক পরিবেশ। বঞ্চিত হবে জাতীয় নদী ঘোষণা থেকে।

সরেজমিনে হালদা পাড়ের বাসিন্দা, ডিম সংগ্রহকারী ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নদীর অনেক স্থানে হাঁটু পানি কোথাও কোমর পানি। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা হারানোর সত্যতা ফুটে উঠে। আগে ডিম সংগ্রহের মৌসুমে যেখানে নব্বই থেকে একশ বিশ ফুট গভীরে নৌকার নোঙর ফেলা হত সেখানে থেমেছে ত্রিশ ফুটে। স্বাভাবিক জোয়ারের পানি কখনো এলাকায় প্রবেশ করেনি এখন জোয়ারের সাথে সাথে বৈরী আবহাওয়া হলেই এলাকার রাস্তাঘাট বাড়ির উঠোন তলিয়ে যায় পানিতে।

হালদা পাড়ের বাসিন্দা ও গড়দুয়ারা ইউপি চেয়ারম্যান সরোয়ার মোর্শেদ তালুকদার বলেন, যেহেতু হালদার উৎপত্তিস্থল পাহাড় সেহেতু প্রতিনিয়ত পাহাড়ের বালুকণা হালদায় এসে পড়ছে। অন্যদিকে হালদা নদীর সাথে অনেকগুলো শাখা খালের সংযোগ রয়েছে। শাখা খালের বালু, আবর্জনা এবং বর্জ্য এসে পড়ছে হালদায়। ড্রেজার দিয়ে খননে হালদা ও তার পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা সত্য কিন্তু প্রশাসন পরিকল্পনা করে যদি ম্যানুয়ালি তথা ডুবুরি দিয়ে বালু উত্তোলনের ব্যবস্থা করে তাহলে ক্ষতি কোথায়। এতে যেমন হালদা গভীরতা ফিরে পাবে তেমনি কিছু বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। একইসাথে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করলে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা পড়বে।

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. ফারুক ময়েদুজ্জামান বলেন, যেহেতু বৃষ্টি হলেই হালদা নদীতে পাহাড়ি উজানের ঘোলা পানি অর্থাৎ পাহাড়ি বালু কণা নেমে প্রবল স্রোতের সৃষ্টি হয় এবং এ নদী লম্বা ও সরু হওয়ায় পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি কণা মিশ্রিত পানিতে হালদা ধীরে ধীরে ভরাট হয় এবং হচ্ছে সেহেতু ম্যানুয়ালি তথা ডুবুরি দিয়ে যদি বালু উত্তোলন করা হয় তাহলে হালদা নদীর তেমন ক্ষতি হবে বলে মনে করেন না। ইতিমধ্যে অনেক জায়গায় চর লক্ষ্য করা গেছে সেখানেও যদি এ পদ্ধতি ব্যবহার করে বালু উত্তোলন করা হয় তাহলে হালদার ক্ষতি নয় বরং উপকার হবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র বলেন, যদি মাটিতে কম্পন না হয় এবং পাড় না ভাঙে একইসাথে পরিবেশের যদি বিপর্যয় না ঘটে তাহলে ম্যানুয়ালি পদ্ধতিতে বালু উত্তোলন করা যায়। হালদার নাব্যতা রক্ষার্তে এনিয়ে অনেকেই এখন চিন্তাভাবনা করছেন। তবে পরিবেশ সমীক্ষা করে ওই দিকে এগোতে হবে। এর জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত লাগবে।

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, জোয়ার ভাটার নদীর অন্যতম সমস্যা হচ্ছে বালি-পলি জমা। পলি জমে নদীর নাব্যতা কমে যায়, পানি প্রবাহ পরিবর্তন, বিভিন্ন জলজ প্রাণীর বাসস্থান ধ্বংস, কুম ভরাট, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, পলিদূষণ, পানির গুনাবলি নষ্ট, ও পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। জোয়ার ভাটার নদী হালদা ও এর শাখাকালের বিভিন্ন স্থানে বালি জমে নদীর গভীরতা কমে গেছে, কুম ভরাট, কার্পজাতীয় মাছের প্রজননস্থান পরিবর্তন ও পানি প্রবাহ কমেছে তাই হালদা নদীকে কার্পজাতীয় মাছ, গাঙ্গেয় ডলফিন এবং জলজ প্রাণীর নিরাপদ বাস্তুতন্ত্রে পরিণত করার লক্ষ্যে হালদায় নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য বালি জমাট স্থান থেকে ম্যানুয়ালি প্রয়োজন মতো বালি অপসারণ করতে হবে।

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া ম্যানুয়ালি বালু উত্তোলনকে সমর্থন করে বলেন, এ পদ্ধতিতে বালু উত্তোলনে যেমন হালদার গভীরতা ফিরে আসবে তেমন বালুর চাহিদা পূরণ হবে। পাশাপাশি যদি হালদার শাখা খালগুলোর প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে দেয়া হয় তাহলে শাখা খালের স্বাভাবিক স্রোতে হালদায় পাহাড়ের জমানো পলি মাটি এমনিতে সরে যাবে।

ইএইচ