তজুমদ্দিনে কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প

ভোলা প্রতিনিধি: প্রকাশিত: জুন ২৭, ২০২৪, ১২:০৭ পিএম
তজুমদ্দিনে কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প
ছবি: আমার সংবাদ

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প। বিভিন্ন উপজেলার ন্যায় ভোলা’র তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়নের, গোলকপুর ৪নং ওয়ার্ডের পালবাড়ির প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ পৃষ্ঠপোষকতা ও নানা সমস্যার কারণে বিলুপ্তির পথে।

বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) সকালে সরেজমিনে গেলে বাধন পাল(৪০) নামের এক যুবক বলেন, এক সময়ে মাটির জিনিসপত্র তৈরিতে কুমার পাড়ায় মৃৎশিল্পীরা সারাক্ষণ ব্যস্ত সময় কাটাতেন। গ্রাম বাংলায় ধান কাটার মৌসুমে এ শিল্পে জড়িত কুমারদের আনাগোনা বেড়ে যেত।সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মাটির হাঁড়ি-পাতিল বোঝাই ভাঁড় নিয়ে বিক্রেতারা দলে দলে ছুটে বেড়াতেন গ্রামগঞ্জে। রান্না ও বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন রকমের হাঁড়ি-পাতিল, সরা, থালা, দোনা, ঝাঁজর, মটকি, গরুর খাবার দেওয়ার চাড়ি, কোলকি, কড়াই, কুয়ার পাট, মাটির ব্যাংক, শিশুদের জন্য রকমারি নকশার পুতুল, খেলনা ও মাটির তৈরি পশুপাখি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ছুটে যেতেন। কিন্তু এখন কাঁচ, আর অ্যালুমিনিয়াম মেলামাইন ও প্লাস্টিকের তৈরি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্পটি।

একই বাড়ির অন্যান্য মৃৎশিল্পীদের সাথে কথা বললে তারা বলেন,একসময় মাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, রঙিন ফুলদানি, ফুলের টপ, হাতি, রঙিন ঘোড়া, নানা রঙের পুতুল ও বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের খেলনা সামগ্রী হাটবাজার ও গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে অনেক লাভবান হতাম।কিন্তু এখন প্লাস্টিক ও অ্যালুমেনিয়ামের চাপে আমরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছি। তারা বলেন, বিভিন্ন পূজাপার্বণে প্রতিমা তৈরি করে যা রোজগার করি তা দিয়ে চালাই সংসার।

একই ওয়ার্ডের পালপাড়ার লক্ষন পাল বলেন, মৃৎশিল্প আগের মতো না চলায় বাধ্য হয়ে গুটিয়ে নিয়েছি আদি ও পূর্বপুরুষের এই পেশা।

এলাকার মৃৎশিল্পী নিউটন পাল (৪৫) জানান, এমন একসময় ছিল যখন এলাকায় অনেকেই মৃৎশিল্পের নির্ভর করে জীবিকা চলত।বর্তমানে এলাকায় ২৫-৩০টি পরিবার বসবাস করলেও প্রায় ১০-১৫টির বেশি পরিবার তাদের বংশীয় পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশা শুরু করেছে।বর্তমানে আমরা যারা এ পেশায় রয়েছে তারা অতিকষ্টে এ পেশা ধরে রেখেছে।

মৃৎশিল্পী দিলিপ পাল পাল ও বাধন পাল বলেন, পিতা-মাতার কাছ থেকে দেখে দেখে এ মাটির কাজ শিখেছিলাম।যখন এ কাজ শিখেছিলাম,তখন মাটির তৈরি জিনিসের চাহিদা ছিল ব্যাপক। একসময় এখানে ভাত, তরকারির পাতিল, বড় কলস, মটকিসহ বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি পাতিল আর বাচ্চাদের খেলনা মিলিয়ে ৪০-৫০ প্রকার জিনিস তৈরি করা হতো। কিন্তু চাহিদা কম ও খরচ বেশি হওয়ায় এখন আর আগের মতো জিনিসপত্র তৈরি করা হয় না।

শম্ভুপুর পাল পারার রাজেশ সাম পাল বলেন, একসময় তাদের গ্রামের পাশের বিভিন্ন জমি থেকে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা গাড়ি মাটি ক্রয় করতে পারতেন। তবে,এখন দেশে বেড়েছে ইটের ভাটা।যার কারণে ৪০০০ থেকে ৫০০০ টাকা গাড়ি মাটি ক্রয় করতে হচ্ছে।আগে খড়ি কেনা হতো ৮০ থেকে ১০০ টাকা মণ,যা বর্তমানে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা মণ কিনতে হয়।অথচ মাটির তৈরি  জিনিসপত্রের দাম তুলনামূলক বাড়েনি।এ জন্য বেশি দামে মাটি, খড়ি কিনে এসব জিনিসপত্র তৈরি করে আগের মতো লাভ হয় না।

তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হারিয়ে যাওয়া এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করছেন স্থানীয় এসব মৃৎশিল্পীরা।

তজুমদ্দিন  উপজেলা প্রশাসক শুভ দেবনাথ আমার সংবাদকে জানান, মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলে জরিপ সম্পূর্ণ করছি। সরকারি ভাবে তাদেরকে প্রশিক্ষণ এবং অনুদানের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। তাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এ শিল্পকে আরো শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসব পণ্য-সামগ্রীর প্রদর্শনাগার তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

বিআরইউ