কোনো কাজই করেন না ফেনীর কর্মক্ষম প্রায় ১০ লাখ মানুষ

ফেনী প্রতিনিধি প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২৪, ০৩:৩৬ পিএম
কোনো কাজই করেন না ফেনীর কর্মক্ষম প্রায় ১০ লাখ মানুষ

ফেনীর ৬০ শতাংশ মানুষই পরনির্ভরশীল। ফলে পারিবারিক বিপর্যয়ের শঙ্কায় রয়েছেন মাত্র ২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলার ১৫ লক্ষাধিক মানুষ।

সম্প্রতি জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরো ও স্থানীয় বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে এ জেলায় মোট জনসংখ্যার ৫৯ দশমিক ৪৬ শতাংশই পরনির্ভরশীল। যেখানে জাতীয়ভাবে নির্ভরশীলতার হার ৫৩ শতাংশ। সেখানে এ জেলায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মাত্র ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ নির্ভরশীল।

এর মধ্যে ফেনীতে শহরের তুলনায় গ্রামে এ পরনির্ভরশীলতার হার আরও বেশি। গ্রামে পরনির্ভরশীলতার হার ৬০ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

পরিসংখ্যান বলছে, সর্বশেষ শুমারিকালে এসব জনগোষ্ঠী কোনো শিক্ষা, অর্থনৈতিক কাজ বা প্রশিক্ষণে নিয়োজিত ছিলেন না।

এছাড়াও বর্তমানে বাংলাদেশ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর আধিক্যের মধ্যদিয়ে দিন পার করছে। এমন জনগোষ্ঠী দেশের উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলেও বাংলাদেশে ঘটছে বিপরীত চিত্র। বাংলাদেশে কোনো কাজেই সম্পৃক্ত নেই এমন লোকের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ।

এর মধ্যে জেলা শহর ফেনী আরও এক ধাপ পিছিয়ে রয়েছে। এই জনপদের কর্মক্ষম প্রায় ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী কোনো কাজের সঙ্গেই সম্পৃক্ত নেই।

সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ফেনীতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে জেলা শহরের তুলনায় গ্রামে পরনির্ভরশীলতার হার বেশি। এতে শিক্ষাজীবনে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর আর পড়াশোনা না করা, প্রবাসে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ছুটে চলা ও নারীদের জন্য অনুকূল কর্ম পরিবেশ গড়ে না ওঠাসহ নানা কারণ ওঠে এসেছে।

জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্য মতে, ফেনীতে মোট জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৮৯৬ জন। তার মধ্যে ৪৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ পুরুষ এবং ৫১ দশমিক ৬৭ শতাংশ নারী। মোট পরিবারের সংখ্যা ৩ লাখ ৭৭ হাজার ১৬৪। জেলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ, যা ২০১১ সালের শুমারিতে ছিল ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১ হাজার ৬৬৫ জন।

মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৯৩৬ জন কর্মে নিয়োজিত, ৪ লাখ ৫৭ হাজার ১৫০ জন গৃহস্থালির কাজে ও ১৯ হাজার ১২৬ জন কর্মের খোঁজ করছেন।

এতে দেখা যায়, জেলায় কাজে নিয়োজিত মোট জনসংখ্যার মধ্যে নারীর তুলনায় পুরুষের হার অনেক বেশি। একইভাবে বর্তমানে যারা কাজ খুঁজছে তাদের মধ্যেও নারীর চেয়ে পুরুষের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি।

এছাড়া ফেনীর কর্মক্ষম ৯ লাখ ৮০ হাজার ৪৩৩ জন মানুষ কোনোরূপ কাজের সঙ্গে জড়িত নেই। এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৫২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ও নারী ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ। 
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, জেলায় ৭ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী পুরুষের মধ্যে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পাস করেছে ১৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ৫ম-৯ম শ্রেণি পাস ৩৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ, এসএসসি-সমমান ও তদূর্ধ্ব শ্রেণি পাস ২৬ দশমিক ১২ শতাংশ এবং কখনো স্কুল - মাদরাসায় যায়নি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ মানুষ।

অন্যদিকে একই বয়সী নারীদের মধ্যে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পাস করেছে ১৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ, ৫ম-৯ম শ্রেণি পাস ৪১ দশমিক ১৬ শতাংশ, এসএসসি-সমমান ও তদূর্ধ্ব শ্রেণি পাস ২৪ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ১৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ কখনো স্কুল-মাদরাসায় যায়নি। এছাড়া জেলার ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী পুরুষের মধ্যে এসএসসি ও তদূর্ধ্ব শ্রেণি পাস ৩৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং একই বয়সী নারীদের মধ্যেই এ হার ২৯ দশমিক ৯১ শতাংশ।

একই সূত্রে জানা যায়, ৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় পুরুষদের অংশগ্রহণ ৭৬ দশমিক ১০ শতাংশ এবং নারীদের হার ২৩ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর মধ্যে উপজেলা ভিত্তিক প্রাপ্ত উপাত্তে দেখা যায়, ফেনী সদরে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী মোট জনসংখ্যার সর্বোচ্চ ৩৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ কাজে নিয়োজিত এবং সোনাগাজীতে এ হার ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ফেনীর সহকারী পরিচালক সাইফ উদ্দিন আহমেদ  বলেন, ফেনীতে তরুণ-যুবকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে স্বনির্ভর হওয়ার চেয়ে সাধারণত প্রবাস যাওয়ার ঝোঁক বেশি। তবুও মাঠপর্যায়ে এ বিষয়ে আমরা কাজ করছি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলা পর্যায়ে ৭৫৫টি ও ছশ উপজেলায় ২ হাজার ৫২০টি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। জেলাপর্যায়ে বর্তমানে ৬টি কোর্স চলমান রয়েছে।

এছাড়া একটি প্রকল্পের আওতায় ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ চলছে। যেখানে বিদেশ গমনেচ্ছু যুবকদের আগ্রহ বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। জেলায় প্রতি অর্থবছরে গড়ে তিন হাজারের বেশি যুবককে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় বলে জানান এ কর্মকর্তা।

এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক বক্তব্যে ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রচেষ্টার উদাহরণ সর্বশেষ প্রযুক্তিনির্ভর জনশুমারি এবং গৃহগণনা। নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছেন। এজন্য সবাইকে পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে উৎসাহ দিতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ও ফেনী ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার প্রফেসর তায়বুল হক শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, উদ্বেগজনক হারে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর পরনির্ভরশীলতার কারণে সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও জীবনযাত্রার মান কমার পাশাপাশি পারিবারিক জীবনেও বিপর্যয় ঘটতে পারে।তিনি বলেন, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল হলে শুধু অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে এমন নয়। এটির কারণে যেমন আঞ্চলিকভাবে সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও জীবনযাত্রার মান কমবে তেমনি জাতীয় পর্যায়েও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভাব পড়বে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে।

তিনি আরও বলেন, ফেনীতে পরনির্ভরশীলতার এমন পরিসংখ্যান আমাদের জন্য শঙ্কার। এই হার অস্বাভাবিক। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি স্বল্প মেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সহায়তার ব্যবস্থা করেন তাহলে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়া যেসব তরুণ দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য সময় অপচয় করছে তাদেরও এই সময়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজে নিয়োজিত হতে হবে। এছাড়া নারীরা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেলাই কাজ বা কুটির শিল্পে নিয়োজিত হতে পারেন। এতে প্রত্যেকে স্বনির্ভর হয়ে পরনির্ভরশীলতার এ হার কমে আসবে।

ইএইচ