‘হোয়াইট কালার’ গডফাদারদের তালিকা করা হচ্ছে খুলনায়

খুলনা প্রতিনিধি প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২৪, ০৬:৩৩ পিএম
‘হোয়াইট কালার’ গডফাদারদের তালিকা করা হচ্ছে খুলনায়

মাদক নামক সামাজিকব্যাধি গ্রাস করেছে খুলনাকে এটা বললে হয়তো ভুল হবে না। ২০২৪ সালের প্রথম ৬ মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে ১৬৭টি ও মেট্রোপলিটনের ৮ থানায় ৭৪৪টি মাদক সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যা মোট মামলার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ।

এত মামলা হলেও থেমে নেই মাদক কারবারিরা। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে চুনোপুঁটির তালিকা থাকলেও হোয়াইট কালার গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন গণমাধ্যম পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত দুই বছরে মাদক সংক্রান্ত এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১৫টি। যা বাস্তবে আরও বেশি বলে মনে করছেন গণমাধ্যমকর্মীরা।

সাম্প্রতিক সময়ে মাদককে কেন্দ্র করে খুলনায় বেড়েছে হত্যার ঘটনা। সবশেষ গত ৯ জুলাই রাতে ২৭নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আল আমিনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। প্রাথমিক তদন্তে মাদকের অর্থ ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তারে এ হত্যা বলে জানায় পুলিশ।

এর আগে একই ঘটনায় গত ২৮ মে ৩০নং ওয়ার্ডের খ্রিষ্টান পাড়ায় রনি সরদার ও ২৩ জানুয়ারি ময়লাপোতা মোড়ে সাদিকুর রহমান রানাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া গত বছরের ৫ আগস্ট সোনাডাঙ্গা এলাকায় শীর্ষ দুই মাদক ব্যবসায়ী গ্রুপের গোলাগুলিতে খুন হয় ইমন শেখ এবং ৫ অক্টোবর গোবরচাকা এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী মো. ইমন শেখ।

খুলনা সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের সভাপতি কুদরাত-ই-খুদা বলেন, ‘আইন, সমাজ ও রাজনৈতিক সমন্বয়হীনতায় বাড়ছে মাদক নামক এই সামাজিকব্যাধি। মাদক কারবারির জন্য খুলনা উর্বর স্থান। কারণ এখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের বিপথে নিতে কাজ করছে একটা বড় চক্র।’

তিনি বলেন, ‘মাদক ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত থাকেন, তারা সামাজে কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় ও পাওয়ারফুল লোক হিসেবে থাকেন। তারা এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই রাজনীতি যদি স্বচ্ছ না হয়, রাজনীতি যদি জনকল্যাণে না হয় তাহলে সমাজের পাশাপাশি সরকারও এসব লোকের জন্য সমালোচিত হয়।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক শীর্ষকর্তা জানান, মাদক বিক্রেতারা কৌশলী হয়েছে। আগে শহর থেকে মাদক ডিস্ট্রিবিউশন হলেও এখন উপজেলা থেকে শহরে আসছে। রুট বদলের পাশাপাশি বদলেছে বিক্রির ধরন। তারা এখন আর মাদক সাথে রাখেন না, নির্দিষ্ট স্থানে রেখে ডিজিটাল প্লাটফর্মে চলে কারবারি। আর যাদের গ্রেফতার করা হয়, তারা এড়িয়ে যান গডফাদারদের নাম। ভুল তথ্য দিয়ে ফাঁসাতে চান প্রতিপক্ষকে।

খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসের বিভিন্ন অভিযানে ১৮২ জনকে আসামি করে ১৬৭টি মামলা করা হয়েছে। আর আলামত হিসেবে ১০৭ কেজি ২৪৫ গ্রাম গাঁজা, ৩৮৪১ পিস ইয়াবা, ১৩৮ বোতল ফেনসিডিল, ১০৪৫ পিস টেপেন্ডা, ৩০ লিটার যাওয়া, ৭ লিটার চোলাই মদ, ২.৮ লিটার অ্যালকোহল উদ্ধার করা হয়। সেই সাথে মাদকের কাজে ব্যবহৃত ২টি মটরসাইকেল, ১টি মেমোরিকার্ড এবং মাদক বিক্রির ৪ লাখ নগদ টাকা জব্দ করা হয়। এর আগে ২০২২ সালের ছয় মাসে ১০৬৪ অভিযানে ১৮৪টি মামলায় ১৯২ জনকে আসামি করে করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ২০২৩ সালে ১৯৬৪ টি অভিযান পরিচালনা করে ৩২৭ মামলার আসামি করে ৩৬৫ জন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘খুলনাঞ্চলে মাদকের শ্রেণির পরিবর্তন হয়েছে। গত কয়েক বছরে ইয়াবার মতো সহজে বহনযোগ্য মাদকের বিস্তার ঘটেছে ভয়াবহ আকারে। পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়েও মাদক কারবারির সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের উপজেলায় কোনো অফিস নেই। জেলা থেকেই সেটা দেখতে হয় এতে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এরপরও আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। মাদক বিক্রির কৌশল পরিবর্তন হওয়ায় আলামতসহ অপরাধী আটকরা চ্যালেঞ্জিং হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার মতো আমাদের ডিজিটাল ডিভাইস ও মনিটরিং ব্যবস্থা থাকলে আরও বেশি অপরাধী ধরা সম্ভব হতো।’

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। ইতোমধ্যে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা করা হয়েছে। এখন হোয়াইট কালার গডফাদারদের তালিকা করা হচ্ছে। যারা অবৈধ মাধ্যমে ফুলেফেঁপে ধনী হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা করা হবে। এছাড়া প্রতিটি এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে মাদক প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। অচিরেই মাদকের অবৈধ ব্যবসা উৎখাত করা হবে। এছাড়া তিনি অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন।’

ইএইচ