দিনাজপুরে বিক্রি করা শিশুকে কোলে ফিরে পেলেন মা

দিনাজপুর প্রতিনিধি: প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪, ০৪:০৯ পিএম
দিনাজপুরে বিক্রি করা শিশুকে কোলে ফিরে পেলেন মা

অভাব-অনটনে বিক্রি করা কোলের শিশু কোলে ফিরে ফেলেন মা রোকেয়া বেগম রত্না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের হস্তক্ষেপে তিনি তার কোলের শিশুকে ফেরত পেলেন বলে জানা গেছে। দিনাজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল রায়হান ও উপজেলা সমাজসেবা অফিসার আসাদুজ্জামান শিশুটিকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন।

এসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দিনাজপুর জেলা সমন্বয়ক একরামুল হক আবিরসহ ছাত্র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তি ওই পরিবারটির সাহায্যে এগিয়ে আসেন।

দিনাজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল রায়হান জানান, আমরা বাচ্চা বিক্রির বিষয়টি জানতে পেরে খোঁজ নেই। আসলে দারিদ্রতার কারণেই আব্দুর রশিদ ও রোকেয়া বেগম রত্না দম্পতি তাদের শিশু বাচ্চাটি লালন-পালনের জন্য নিঃসন্তান দুর সম্পর্কের আত্মীয়ের কাছে দেন। তাদের বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায়।

তিনি বলেন, আমরা কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় ৯ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ১২টায় বাচ্চাটিকে নিয়ে এসে বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেই। বাচ্চার তাৎক্ষণিক ভরণপোষণের জন্য ইতোমধ্যে ৬৫ হাজার টাকা সহায়তা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বাচ্চাটির সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নেয়া হবে এবং ভবিষ্যতেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা অব্যাহত থাকবে।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক একরামুল হক আবির জানান, আমরা আসলে দেখেছি মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। যারা বাচ্চাটি লালন-পালনের জন্য নিয়েছিল, তারাও তাকে অনেক আপন করে নিয়েছিল। ইতোমধ্যে

শিশুটিকে নিয়ে গিয়ে ঘটা করে আকিকা অনুষ্ঠান করে। তারা শিশুটির নাম রেখেছে তানহা।

বাচ্চাটি আনার সময় তাদের কান্নায় এলাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সেখানে থাকা শিশুটির নতুন মা কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। বাবাটিও কান্নায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। আমরা বাচ্চাটিকে আনলেও জন্মদাতা বাবা ও মাকে আমরা বলেছি-তাদের সাথে যেন যোগাযোগটি রাখা হয়। আর আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই বাচ্চার বিষয়ে প্রথম থেকেই সার্বিক সহায়তা প্রদান করে আসছি। ভবিষ্যতেও আমরা সহায়তা অব্যাহত রাখবো।

এর আগে ৪ আগস্ট দুপুরে গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে দিনাজপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়মিত চেকআপ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন দিনাজপুরের কাটাপাড়া এলাকার ট্রাক্টরের হেলপার আব্দুর রশিদ। পরে গত ১০ আগস্ট আব্দুর রশিদের স্ত্রী রোকেয়া বেগম রত্মা একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। নিঃস্ব ও হত-দরিদ্র আব্দুর রশিদের আরেকটি কন্যা সন্তান রয়েছে। রোজা নামের ওই সন্তানটির বয়স ১৪ মাস। রোজার পিঠে একটি টিউমার রয়েছে। টাকার অভাবে রোজারও চিকিৎসা করাতে পারছে না আব্দুর রশিদ। এমন অবস্থায় আরেকটি সন্তান। আবার আব্দুর রশিদ গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন।

এ অবস্থায় উপায়ান্তর না পেয়ে ৩ দিনের ওই শিশু তানহাকে দূর সম্পর্কের এক নিঃসন্তান আত্মীয়কে লালন-পালনের জন্য দিয়ে দেন। বিনিময়ে ওই আত্মীয়রা খুশী হয়ে আব্দুর রশিদের চিকিৎসার জন্য তাদেরকে ২৫ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান করে। এটিকে ২৫ হাজার টাকায় সন্তান বিক্রি করা হয়েছে মর্মে প্রচার পায়।

এ ব্যাপারে মা রোকেয়া বেগম রত্মা জানান, আমি সন্তান বিক্রি করিনি। অভাব-অনটনের কারণে লালন-পালনের জন্য নিজ ইচ্ছায় প্রদান করেছি।

আব্দুর রশিদ জানান, আমার মাথা গোজার ঠাঁইটুকুও নেই। অন্যের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে এখন বসবাস করি। আমার শারীরিক অবস্থা এখনও পুরোপুরি ভালো নয়, শরীরে আরও গুলি বা স্পিলিন্ডার রয়েছে। একটি স্পিলিন্ডার রয়েছে তার প্রস্রাবের রাস্তায়। ডান পায়ের উরুর উপরে রয়েছে আরও ৩টি স্পিলিন্ডার।

এছাড়াও হাতে ও পেটেও আরও স্পিলিন্ডার রয়েছে বলে জানিয়েছেন আব্দুর রশিদ। প্রতিদিন ওষুধ লাগছে, প্রস্রাবের ড্রেন করে দেয়া হয়েছে নাভির উপর দিয়ে। সেই থলিও বদলাতে হয় কয়েকদিন পর পর। এরপর রয়েছে তার বড় সন্তান, তার দাদা-দাদি ও তার স্ত্রীর খাওয়া। সব মিলিয়ে এক অসহায় পরিবার। চিকিৎসক তাকে জানিয়েছে, তার শরীরে আরও অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন।

তিনি বলেন, গুলিবিদ্ধের ঘটনার সাথে আমার কোন অপরাধ ছিল না, স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর আমার গুলি লাগে। কিন্তু এখন আমাকে যন্ত্রণা নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে। আমাকে প্রতিনিয়তই হাসপাতালে যেতে হচ্ছে, যেসব ওষুধ পাচ্ছি- তাছাড়াও বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। ছাত্ররা, প্রশাসন, জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক সংগঠন আমাকে সহযোগিতা করছে, আবার কোনো কোনো ব্যক্তিও সহযোগিতা করছে। এজন্য আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।

তিনি জানান, আমার আরও অপারেশন করা লাগবে, আমি বাঁচতে চাই, সুস্থ্য হতে চাই।

উল্লেখ্য, আব্দুর রশিদের বাড়ি পঞ্চগড় জেলার ভজনপুরে। সেখানে তার সৎ মা ও দুই ভাই রয়েছে। বাবার জমি-জমাও নেই। দিনাজপুরে অন্যের একটি পরিত্যক্ত বাসায় তারা এখন বসবাস করছে।

বিআরইউ