জেলা প্রশাসকের আর্থিক সহায়তা

ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত সোহাগের মায়ের কান্না থামছে না

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪, ১২:১৩ পিএম
ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত সোহাগের মায়ের কান্না থামছে না

ও বাবা সোহাগ রে... আমার বুকের ধন সোহাগ রে হুলিশে (পুলিশ) গুলি দিয়া মারছে গো...। তোমরা আমার পুত রে আইনা দেও...। আমার সোহাগরে আইন্না দেও। আমরা গরিব মানুষ কামকাজ কইরা খাই; আমার পুতরে গুলি দিয়া মারছে গো। আমার পুত রে গুলি দিয়া মারছে।

এই দেশের হুলিশ (পুলিশ) কেমন মানুষ এরা, নিজ দেশের মানুষকে গুলি কইরা মারে। যারা আমার পুত রে মাইরা আমার বুক খালি করছে; এই বিচার আমার আল্লাহ্‍‍`য় যেন করে। ও..আল্লাহ তুমিই আমার বিচারক, তুমার কাছেই বিচার চাইম গো...।

এমন বিলাপ করে বুক চাপড়িয়ে পুত্র শোকে আহাজারি করে কাঁদছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত শ্রমিক সোহাগ মিয়ার গর্ভধারিণী মা। মায়ের কান্না শুনে যে কারো চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। সন্তান হারিয়ে হতদরিদ্র মায়ের কান্না থামছেই না। বাবার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। কেউ বাড়িতে গেলে শুধু মুখ লুকিয়ে হু-হু করে শব্দ করে চোখের পানি মুছে।

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা ভীমখালি ইউনিয়নের গোলামীপুর গ্রামের ছোট্ট একটি ঘরের কাছেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন সোহাগ মিয়া। তার কবরের পাশেই উড়ছে লাল সবুজের প্রতীক জাতীয় পতাকা।

বাবা মো. আবুল কালাম ছেলের কবেরে পাশে এসে কাঁদেন আর হা-হুতাশ করে মোনাজাত করেন। নতুন কেউ বাড়িতে গেলে ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকেন। এমন হৃদয় স্পর্শী দৃশ্য যে কারো চোখে পড়লে অশ্রুসিক্ত হবেন তিনি ।

বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়ার উপস্থিতি জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালি ইউনিয়নের গোলামীপুর গ্রামে গিয়ে এমন করুন দৃশ্য চোখে পড়ে।

স্থানীয়রা জানান, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের খবরে (পাঁচ আগস্ট) সারাদেশে উৎফুল্ল কোটি ছাত্র-জনতা প্রতিটি পাড়া মহল্লায় বিজয় মিছিল করে। সেই বিজয় মিছিলের মিলন মেলায় ঢাকার রাজপথের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের গুলামিপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. সোহাগ মিয়া ও তার ছোট ভাই শুভ মিয়া। দুই ভাইয়ের একসঙ্গে শেষ বিজয় উল্লাসই ছিল এটি। এ সময় নির্দয় পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে গুলিবিদ্ধ হন দুই ভাই। পুলিশের গুলিতে নিহত হন সোহাগ মিয়া। পায়ে গুলি লাগে অপর ছোট ভাই শুভ মিয়ার। রাজধানীর বাড্ডা এলাকার মিছিলে যুক্ত হয়েছিলেন ওরা দুই ভাই।

বাড্ডা থানার সামনে মিছিলটি আসা মাত্রই পুলিশ গুলি চালায়। সেই মিছিলে দুই ভাই গুলিবিদ্ধ হলে প্রাণ পাখি উড়ে যায় সোহাগ মিয়ার এমটিই জানিয়েছেন নিহতের ছোট ভাই গুলিবিদ্ধ শুভ মিয়া। পরদিন ছয় আগস্ট অনেক কষ্টে সোহাগের লাশ তার নিজে গ্রামের বাড়িতে এনে জানাজা শেষে দাফন করা হয় ঘরের পাশেই কবরস্থানে।

অপর ভাই শুভ মিয়ার পায়ে এখনো ছররা গুলি আটকে আছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না বলে জানালেন তিনি।

দিনমজুর আবুল কালামের ছয় ছেলে—মেয়ে। অভাবের তাড়নায় সন্তানরা লেখা পড়া করতে পারেনি। সন্তানদের মধ্যে সোহাগ ছিলেন তৃতীয়। ২০১৯ সালে সোহাগকে প্রবাসে পাঠাতে ঋণ ও জায়গা জমি বিক্রি করে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন এক দালালের হাতে। সেখানেও প্রতারিত হন সোহাগের পিতা আবুল কালাম। এই ঋণের টাকাই পরিশোধে করতেই নিজ এলাকা ছেড়ে রাজধানীতে গিয়ে বিভিন্ন কাজে যোগ দেন তারা।

বাড্ডা এলাকায় একটি পোষাক কারখানায় কাজে যোগ দেন সোহাগ মিয়া। গত ৫ আগস্ট ছাত্র—জনতার বাঁধ ভাঙ্গা মিছিল দেখে নিজেদের আটকাতে পারেনি এই তরুণরা। যোগ দেয় মিছিলে। বাড্ডা থানার সামনে আসতেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন সোহাগ তার ছোট ভাই শুভ গুলিবিদ্ধ হন। পরে অন্যরা হাসপাতালে নিয়ে যান। তার ভাইয়ের শরীরেও গুলি লেগে সেখানেই মারা যায় বলে জানান শুভ মিয়া।

তিনি বলেন, হাসপাতালে সার্মথ্য অনুযায়ী চিকিৎসা করিয়ে বাড়িতে চলে আসি। এখনও পায়ে দু’টি গুলি রয়ে গেছে। আগের মতো কাজ করতে পারি না। পা ব্যথা করে। টাকা পয়সার অভাবে অপারেশন করে গুলি বের করতে পারছি না।

শহীদ সোহাগের বড় ভাই মো. বিল্লাল মিয়া বললেন, ২০১৯ সালে ভাইকে বিদেশ পাঠানোর জন্য জায়গা জমি, গরু বিক্রি করেছি তবুও টাকা মেলাতে না পারায় মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দিয়েছি। সেই দালাল আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এক টাকাও ফেরত পাইনি। পরে ঋণের চাপে আমরা পাঁচ ভাই এলাকা ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে কাজ শুরু করি।  
ছেলে হারানোর শোকে কাতর মা রোকেয়া বেগম বললেন, ‘আমার পুত ঘরে আয়া আমারে জড়াইয়া ধরতো। শত কষ্টেও আমার মন ভালো হয়ে যাইতো আজ আমার পুত সোহাগ মিয়া নাই, কই গেলিরে পুত বলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি...।’

ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন সোহাগের বাবা আবুল কালাম বললেন, আমি হার্টের রোগী চার বছর ধরে কাম কাজ করতে পারি না। ঢাকা থেকে আমার পুতাইনে (ছেলেরা) কাজ কইরা টাকা পাঠায় কোন রকম সংসার চলে। আমার পুত সোহাগ মারা যাওয়ার পর সবাই বাড়িতে আছি, দেনা করে কোন রকম সংসার চলছে বলে জানান তিনি।

এক শতক জায়গায় একটি ভাঙা ঘরে মাথাগুঁজার ঠাঁই শহীদ সোহাগের পরিবারের। ছাল ফুটো, বাঁশের ঘরে জঙ্গার পড়া টিন বৃষ্টি হলে পানি পড়ে ঘরে।

এলাকাবাসী শহীদ সোহাগের পরিবারের এক মাথা গোজার ঠঁই ও গুলিবিদ্ধ শুভ মিয়ার উন্নত চিকিৎসার দাবি জানান।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া শহীদ সোহাগের বাড়ি পরিদর্শন করে বলেন, আমি শহীদ সোহাগ মিয়ার বাড়িতে গিয়ে তার কবর জিয়ারত করেছি। তার পিতা-মাতা ও গুলিবিদ্ধ ভাই শুভ মিয়ার সাথে দেখা করে কথা বলেছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা প্রাদান করা হয়েছে। তবে এইটা যথেষ্ট নয়। আমরা আশা করছি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে সরকারি সহযোগিতার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

গুলিবিদ্ধ সোহাগের সুচিকিৎসার জন্য তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দিয়ে তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা আহত সকলের চিকিৎসা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন, এতে প্রয়োজনে আমাদের পক্ষ থেকে ইউএনও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে সহযোগিতা করবেন।

ইএইচ