জমে উঠেছে প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো ঢাকের হাট

আশরাফুল ইসলাম তুষার ও আরমান মিয়া কটিয়াদি প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২৪, ০৪:৫৩ পিএম
জমে উঠেছে প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো ঢাকের হাট

প্রায় ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট প্রতিবছরই কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার পুরান বাজারের মুক্তিযোদ্ধা অফিসের কাছে বসে। এবারও বসেছে দুদিনের ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট। প্রায় ৫০০ বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে।

দুর্গাপূজার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হতে-না হতেই দূরদূরান্ত থেকে ঢাক, ঢোল, সানাই আর বংশীবাদকরা আসেন এই হাটে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে। পূজার আয়োজকরাও এ হাট থেকে পূজা উদযাপনের লক্ষ্যে যাচাই-বাছাই করে নিয়ে যান তাদের পছন্দের বাদকদের।

ষষ্ঠী থেকে দশমীতে বিসর্জন পর্যন্ত মণ্ডপগুলোকে উৎসবমুখর করে রাখেন তারা। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শোনা যায় বাদ্যের বাজনা আর সুরের মূর্ছনা। পূজারিরাও মগ্ন থাকেন নিত্যনতুন রঙ-বাহারি সাজে দেবী অর্চনায়।

জনশ্রুতি এই যে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার প্রাসাদে জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধানে ঢাকার তৎকালীন বিক্রমপুর পরগণার (বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। তার বার্তা পেয়ে সেই সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকি দল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একের পর এক সবার বাজনা শুনে সেরা দলটিকে বেছে নেন আর পুরস্কৃত করেন। এভাবে রাজা প্রতিবছরই ঢাকিদের বেছে নিতে শুরু করেন। মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি পুরস্কৃতও করেন। এই ঘটনার ধারাবাহিকতায় যাত্রাঘাটে শুরু হয় ঢাকের হাট। সেই হাট স্থানান্তর হয়। এখন বসছে বর্তমান পুরান বাজার মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স মাঠে। প্রতিবছর পূজা শুরুর আগের দুদিন এই হাট বসে৷ মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া এই হাট চলবে বুধবার পর্যন্ত।

ঢাকের হাটে গিয়ে দেখা গেছে, জৌলুস খানিকটা কমেছে। কারণ তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার ঘটায় অনেকে এখন মোবাইলেই ঢাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চুক্তি করে ফেলেন। তারপরও গতকাল ঢাকের হাটে ৬০টির বেশি ঢাকি দল তাদের চুক্তি চূড়ান্ত করে নিজ নিজ মণ্ডপে ফিরে গেছে। পূজারীদের দেখা পেতে তখনও অপেক্ষায় রয়েছে ৩৫-৪০টি ঢাকি দল। ঢাকিদের হাতে কাঁসর, সানাই, নানা বাঁশি, করতাল ও খঞ্জরি। বিরতি দিয়ে দলভিত্তিক বাদ্য বাজাচ্ছেন তারা। কারণ কোন দলের কত মূল্য হবে, তা নির্ধারিত হয় উপস্থিত বাজনাদের মুনশিয়ানা ও সৌন্দর্যেও পরীক্ষায় উত্তীর্ণের মধ্য দিয়ে। দামও বাড়তে থাকে তাদের মুনশিয়ানার ধরন দেখে। বাজনার তালে নাচ আর নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে পূজারিদের নজর কাড়ারও চেষ্টা করেন ঢাকিরা।

ঢাকঢোল নিয়ে মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা বিজয় কুমার বলেন, ‘দেশের অন্য কোথাও ঢাকের হাট আছে বলে আমার জানা নেই। তাও আবার ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে টিকে থাকা হাট! প্রতিবছর হাটে আসার জন্য অপেক্ষায় থাকি। এখানে এসে মণ্ডপে যাওয়ার সুযোগ হয়। তাছাড়া অনেক ঢাকির সাথে দেখা হয়। কথা হয়।

আয়োজকরা জানান, দুইদিনে তিনশর মতো ঢাকির সমাগম ঘটে এই হাটে। ঢাক ছাড়া অন্য কিছুর কেনা-বেচা হয় না এখানে।

লেখক, ছড়াকার ও গবেষক জাহাঙ্গীর আলম জাহান জানালেন, কিশোরগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্যে ঢাকের এই হাটটির স্থান গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অন্য কোনো স্থানে ঢাকের হাট আছে কি না জানা নেই তার। বর্তমানে অনেক ঢাকিই চুক্তিবদ্ধ হন মোবাইল ফোনে। ফলে দিন দিন কিছুটা হলেও এ হাটের ঐতিহ্য ম্লান হচ্ছে। ঢাকের হাটের ঐতিহ্য ধরে রাখতে স্থানীয় সচেতনমহলসহ প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাজারের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাজনা বাজাচ্ছেন তারা। কেউ রিকশা থেকে দলবল নিয়ে সবেমাত্র নামছেন৷ কেউ আগের রাতেই এসেছেন। কেউ চুক্তি হয়ে যাওয়াতে চলে যাচ্ছেন। অনেক দল বায়না না হওয়া পর্যন্ত হাটে অবস্থান করবেন৷ এইবার হাটে দুই শতাধিক ঢাকি এসেছে বলে আয়োজকরা জানান। স্থানীয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক পূজারিরা এসেছেন পছন্দের বাদক দলটি নিতে। ৩০-৪০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১ লক্ষ টাকায় চুক্তি হয়ে অনেক দল চলে গেছে।

ঢাকার দোহার নবাবগঞ্জ থেকে আগত বরুণ দাস বলেন, আমার দলে ছয় সদস্যের ঢাকি৷ একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে একসাথে আমরা চল্লিশ জন আসছি ৷ বায়না হলে বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে চলে যাবো।

নরসিংদীর বেলাবো থেকে আসা নিতাম বলেন, এইবার স্থানীয়ভাবে চুক্তি হয়নি, তাই কটিয়াদীর ঢাকের হাটে আসলাম৷ পাঁচ সদস্যের দল আমাদের৷ ত্রিশ হাজার চাচ্ছি৷ বিশ হাজার বায়না বলা হচ্ছে৷ আরেকটু দেখে চুক্তিবন্ধ হয়ে যাবো।

কটিয়াদী উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব প্রভাষক ধ্রুব রঞ্জন দাস বলেন, এই ঢাকের হাট আমাদের ঐতিহ্য। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ঢাকিদের দেখাশোনা ও তদারকি করছি৷ হাটে অস্থায়ী মনিটরিং কেন্দ্র স্থাপন রয়েছে৷ স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে৷ এলাকাবাসী সবাই সহযোগিতা করছে৷

কটিয়াদী পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শিবু প্রসাদ বণিক জানান, পঞ্চমীর দিন শতাধিক ঢাকি দল চুক্তিবদ্ধ হয়ে হাট ছেড়েছেন। সর্বোচ্চ ১ লাখ এবং সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকায় ঢাকিরা মণ্ডপে গেছেন। সবশেষে দেখা যাবে কিছু ঢাকির জন্য মণ্ডপ মিলবে না। তাদের খাওয়াদাওয়া ও যাতায়াতের খরচ আমরা বহন করব।

কটিয়াদী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, কটিয়াদীর এই ঢাকের হাটের ইতিহাস ৫০০ বছরের বেশি সময়ের পুরোনো। এ কারণে হাটটি জেলার সব ধর্মের মানুষের কাছে ইতিহাস–ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে। হাট বসে দুর্গাপূজা ঘিরে। পঞ্চমী ও ষষ্ঠী হাটবার। এবারও একই নিয়ম মেনে পুরানবাজারে বসেছে ঢাকের হাট।

ঢাকিদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ কাজ করছে৷ শান্তিপূর্ণ ও আনন্দঘন পরিবেশে হাট চলছে।পূজাসহ ঢাকের হাটের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ইএইচ