সিলেট মহানগরের কাষ্টঘর এলাকা থেকে বন্দরবাজার ফাঁড়ির একদল পুলিশ ধরে নিয়ে আসে রায়হান আহমদ (৩২) নামের যুবককে। শেষ রাতে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় ১০ হাজার টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু পরিবার টাকার ব্যবস্থা করতে দেরি করায় রায়হানকে বেধড়ক মারপিট করেন ফাঁড়ির সেসময়ের ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়াসহ তার টিমের সদস্যরা।
ভোরে রায়হান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সকালে পুলিশ তাকে নিয়ে যায় হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হতভাগা সেই যুবক।
দেশ-বিদেশ তোলপাড় করা সেই হত্যাকাণ্ডের আজ ৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ এই সময়েও শেষ হয়নি চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার বিচারকাজ।
অভিযোগ রয়েছে- নানা ফন্দিতে আসামিপক্ষ বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত করছেন।
২০২০ সালের ১১ অক্টোবর ভোররাতে সিলেট মহানগরের আখালিয়ার নেহারীপাড়ার বাসিন্দা রায়হান আহমদ বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন। রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে স্বাভাবিক অবস্থায় রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে আনে পুলিশ। সকাল ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে রায়হানকে কাঁধে করে ফাঁড়ি থেকে বের করা হয়। ৬টা ৪০ মিনিটে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং ৭টা ৫০ মিনিটে মারা যান রায়হান।
পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠে- মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্যে এস.আই আকবরের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা রায়হানকে পিটিয়ে হত্যা করেন। ওইদিনই ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ দাফন করা হয়। এরপর ১৫ অক্টোবর কবর থেকে রায়হানের লাশ উত্তোলন করে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুনরায় ময়না তদন্ত করা হয়।
নির্যাতন করে রায়হানের হাতের দু’টি আঙ্গুলের নখ তুলে ফেলেন এসআই আকবর। ময়নাতদন্তে রায়হানের শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৪টি আঘাত ছিল গুরুতর। নির্যাতনের সময় রায়হানের আর্তচিৎকারে ফাঁড়ির পার্শ্ববর্তী কুদরত উল্লাহ রেস্ট হাউসের বর্ডারদেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল পরবর্তীতে জানান তারা।
ঘটনার পরদিনু রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে সিলেট কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন।
এদিকে, ঘটনার পর আকবর হোসেন ভুঁইয়া সীমান্ত হয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। ঘটনার ২৮ দিন পর ৯ নভেম্বর সকালে কানাইঘাটের সীমান্ত এলাকায় ভারতের অভ্যন্তরে খাসিয়াদের হাতে আটক হয় আকবর। পরে তাকে বিজিবি আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। ওইদিনই তাকে গ্রেপ্তার করে সিলেটে নিয়ে আসা হয়।
ঘটনার প্রায় এক বছর পর (২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর) সিলেটের তৎকালীন অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আব্দুল মোমেন প্রধান আসামি আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ ৫ আসামির উপস্থিতিতে মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। এর আগে ওই বছরের ৫ মে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই সিলেটের পরিদর্শক আওলাদ হোসেন ৫ আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/২০১/৩৪ তৎসহ নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন ২০১৩ এর ১৫(১) (২) (৩) ধারায় সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্রটি দাখিল করেন। টানা ২০২ দিনের তদন্ত শেষে দেয়া অভিযোগপত্রে এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ৫ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনকে আসামি করা হয়।
তারা হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আপগঞ্জ থানার বাগইর গ্রামের মো. জাফর আলী ভূঁইয়ার পুত্র এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়া (৩২), হবিগঞ্জের মোহনপুরের মৃত আমির হোসেনের পুত্র দারোগা হাসান উদ্দিন (৩২), ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার চামারুল্লা গ্রামের মৃত আতাউল করিমের পুত্র এএসআই আশেকে এলাহি (৪৩), সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার উক্তচন্দ্র গ্রামের অনিল কুমার দাসের পুত্র কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস (৩৮), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার একডালা গ্রামের আব্দুন নুরের পুত্র কনস্টেবল হারুনুর রশিদ (৩২) ও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বড়দেও (শমশেরনগর) গ্রামের ইসরাইল আলীর ছেলে আব্দুল্লাহ আল নোমান (২৮)।
আসামিদের মধ্যে আকবর হোসেন ভুঁইয়া, আশেকে এলাহী, টিটু চন্দ্র ও হারুনুর রশিদ সরাসরি রায়হান হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। হাসান উদ্দিন ও আব্দুল্লাহ আল নোমান এস.আই আকবারকে পালিয়ে যেতে সহায়তা সহ আলামত নষ্ট করে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল তৎকালীন সিলেট মহানগর দায়রা জজ মো. আবদুর রহিম পাঁচ আসামির উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে চাঞ্চল্যকর রায়হান আহমদ হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। এর আগে ওই বছরের ১২ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের তারিখ নির্ধারণ থাকলেও সেটি পিছিয়ে নেওয়া হয়। অভিযোগ গঠনের পর মামলার বাদী নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তারের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে আদালতে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন। পরবর্তীতে নিহত রায়হানের গর্ভধারিণী মা সালমা বেগম সহ একে একে ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন আদালত।
আদালত সূত্র জানায়- রায়হান আহমদকে হত্যার আগে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল তৌহিদ হোসেনের মোবাইল ফোন দিয়ে রায়হানের মায়ের কাছে টাকা দাবি করেন। মামলার সাক্ষী ওই কনস্টেবল তৌহিদকে এখন আবারও জেরা করতে চান আকবরের আইনজীবীরা। যদিও সাক্ষ্য গ্রহণের সময় কনস্টেবল তৌহিদকে জেরা করা হয়েছিল। মামলার ৬৯ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালত ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। গত ২ সেপ্টেম্বর সিলেট মহানগর দায়রা জজ হাবিবুর রহমান চাঞ্চল্যকর এই মামলার আসামি পরীক্ষার দিন ধার্য ছিল। প্রধান আসামি এসআই আকবরের পক্ষে কনস্টেবল তৌহিদকে পুনরায় জেরার আবেদন করা হলে আদালত সেটি মঞ্জুর করেন।
এদিকে, জামিনে বেরিয়ে এসে আসামি এস.আই হাসান আলী দেশ ছেড়ে পালিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। গত চারটি ধার্য তারিখ ধরে তিনি আদালতে হাজির না হওয়ায় তার পালিয়ে যাবার বিষয়ে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হচ্ছে। তবে বাকি আসামিরা কারাগারে আছেন।
সূত্র বলছে, ৫৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের পর হঠাৎ করে আসামি কনস্টেবল হারুনের আইনজীবী গত বছর পুরাতন ২৭ জন সাক্ষীকে নতুন করে পুনরায় জেরা করার আবেদন করেন। বাদীপক্ষ এই আবেদনের বিরোধিতা করেন। বিরোধিতা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি অ্যাডভোকেট নওশাদ আহমদ চৌধুরীও। ওই সময় পিপি বলেন- এভাবে পুরাতন সাক্ষীকে নতুন করে জেরা করা হলে মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হবে।
উভয় পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে আদালত পুরাতন ৭ সাক্ষীকে নতুন করে জেরা করার অনুমতি দেন। ওই সাক্ষীদের পুনরায় জেরা করা হয়। পরবর্তীতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডকারী ম্যাজিস্ট্রেট, ময়না তদন্তকারী ডাক্তার ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, এই মামলার শুনানির শেষ তারিখ ছিল গত ২ অক্টোবর। কিন্তু মামলার প্রধান আসামি বরখাস্তকৃত এসআই আকবরের পক্ষে এক সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার আবেদন করেন তার আইনজীবী। আকবরের পক্ষে ইতঃপূর্বে আরও সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করা হয়েছে। আদালত তাদের আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ২৩ অক্টোবর পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন। ওই সাক্ষীকে আসামিপক্ষের আইনজীবী পুনরায় জেরা করবেন।
রায়হানের পরিবারের অভিযোগ- এই ফন্দিতে বিচারকাজ বিলম্ব করতে চাইছেন আকবর। রায়হানের হতভাগ্য মা সালমা বেগম তার গর্ভের সন্তানের খুনিদের বিচারের দাবিতে পথ চেয়ে আছেন।
সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত পিপি অ্যাডভোকেট জুবায়ের বখত বলেন- মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী ধাপে আসামি পরীক্ষা করার কথা। গত বুধবার (২ অক্টোবর) ছিল আসামি পরীক্ষার ধার্য তারিখ।
বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবুল ফজল চৌধুরী জানান, হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই আসামিরা মামলা দুর্বল করতে চেষ্টা করে। এরপর বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত করতেও নানান চেষ্টা করে। সর্বশেষ সাক্ষ্য গ্রহণ যখন শেষ করা হয়ে আদালত যে ধার্য তারিখে আসামি পরীক্ষা করবেন তখনও আসামিপক্ষ এক সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করার আবেদন করেন। আদালত আসামিপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছেন যে, তারা আর কোনো সাক্ষীকে পুনরায় জেরা করতে চান কিনা।
আসামি পক্ষের আইনজীবী জানিয়েছেন- শুধুমাত্র ওই সাক্ষীকেই তারা পুনরায় জেরা করবেন, আর কোনো সাক্ষীকে পুনরায় জেরার আবেদন করবেন না। ইতোমধ্যে আসামিপক্ষ তাদের চাহিদা অনুযায়ী সাক্ষীদের পুনরায় জেরা করে ফেলেছেন
ইএইচ