নিষিদ্ধ পলিথিনে সর্বনাশ কীর্তনখোলা

বরিশাল ব্যুরো: প্রকাশিত: নভেম্বর ৩০, ২০২৪, ০৩:০৩ পিএম
নিষিদ্ধ পলিথিনে সর্বনাশ কীর্তনখোলা

‘আইতে শাল যাইতে শাল, তার নাম বরিশাল’। বেশ প্রাচীন জনপদ বরিশাল। প্রাচ্যের ভেনিস নামে খ্যাত বরিশালের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যার মধ্যে রয়েছে কীর্তনখোলা নদীও। আর এই নদীর সাথে সংযোগ রয়েছে অসংখ্য খাল। সে জন্যই প্রবাদ তৈরি হয়েছে ‘ধান নদী খাল, এই তিনে বরিশাল’। তবে বছরের পর বছর ধরে এই নদীতে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যসহ যাবতীয় ময়লা আবর্জনা ছুড়ে ফেলা এবং অবৈধ দখলের কারণে নদীর সৌন্দর্য এখন বিলীনের পথে। ফলে অচিরেই কীর্তনখোলা তার চিরচেনা রূপ হারাবে বলে এমনই মনে করছেন নগরবাসী।

স্থানীয়রা বলছেন, দখল আর দূষণে কারণে কীর্তনখোলা নদী দিন দিন সরু হচ্ছে। নদীকে বাঁচাতে প্রশাসন শিগগির পদক্ষেপ না নিলে এর ভয়াবহ মাশুল দিতে হবে আমাদের। ফলে এ বিষয়ে প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ চান তারা।

বরিশালের জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন এর উদ্যোগে নগরীর সাতটি খালকে ঘীরে চলছে পরিচ্ছন্নতা অভিযান। অন্যদিকে বরিশালের গুরুত্বপূর্ণ দুটো বাজারের সব প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যসহ যাবতীয় ময়লা আবর্জনা নিয়মিত ভাবে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে খাল ও নদীতে। যে কারণে ব্যাহত হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা অভিযান।

একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, খাল ও নদীতে ময়লা আবর্জনা জোয়ারের পানিতে পুনরায় ভিতরের খালগুলো ভরাট করে দিচ্ছে। আবার ভাটার সময় অনেক ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্য চলে যাচ্ছে কীর্তনখোলা নদী হয়ে দূরদূরান্তে। যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। সম্প্রতি বরিশালের রিপোর্টার্স ইউনিটির মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারা এনিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসও চালিয়েছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বরিশালের চকবাজার এলাকার হাটখোলা ব্রিজ থেকে জেল খালের ডানে ও বামে দেখা গেছে অসংখ্য প্লাস্টিক বর্জ্য ও ময়লা আবর্জনার স্তূপ। যা রীতিমতো খালপাড় ভরাট করে দিচ্ছে। এই খালের পাড় ধরে পোর্ট রোড বাজারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ে ভাসমান পানির বোতল, পলিথিন ব্যাগ, বিভিন্ন প্লাস্টিক উপকরণসহ ময়লা আবর্জনা রীতিমতো স্তূপ হয়ে আছে মাছ ঘাট বা ট্রলার ঘাট এলাকায়। যার প্রমাণ ছবিতে স্পষ্ট দেখা যায়।

একাধিক মাছ ব্যবসায়ী ও জেলেসহ স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এগুলো মাছ বাজারের কেউ ফেলেনি। কিছু হয়ত এখানকার অন্য ব্যবসায়ী বা ক্রেতারা ফেলেছেন। তবে বেশিরভাগই ভেসে এসেছে বলে জানান তারা।

এই বাজার এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বকার প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, বাজারের ইজারাদারদের এটা করা উচিত। 

আবার কেউ বলেন, এটি থেকে লাভবান যেহেতু সিটি করপোরেশন ও নৌ বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাই তাদেরই এটি নিয়মিত পরিষ্কার করা দরকার।

সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে সড়ক ও বাজারের ময়লা আবর্জনা, ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বরিশাল নদী বন্দরের উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক এখন ব্যস্ত ইজারা পরিধি বাড়িয়ে সরকারের আয় বাড়াতে। যে ঘাটের ইজারা প্রথা বাতিল করা হয়েছে, তিনি সেগুলোসহ বরিশালের স্প্রীডবোট ঘাটও ইজারার বন্দোবস্ত দিতে চান জানিয়ে বলেন, নদী তীরবর্তী এলাকা এবং এর তলদেশ মেরিন বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্ব।

ইতিপূর্বে বরিশালের নৌ বন্দর এলাকা থেকেই টনকে টন প্লাস্টিক বর্জ্য উঠে আসে। যা নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বরিশালের জেলা প্রশাসনসহ সুশীল সমাজ। গত ৫ জুন ২০২৪ সারাদেশের মতো বরিশালেও পালিত হয়েছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ।

Displaying BSL-01.jpeg

এবারের এই প্রতিপাদ্য বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী বলে আলোচনা করলেও পরবর্তীতে এই উদ্যোগ কোন কাজে লাগেনি। ৫ আগস্টের পদপরিবর্তনের পর পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্লাস্টিক পণ্য বর্জনের জন্য পলিথিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারী করলে পুনরায় বিষয়টি আলোচিত হতে শুরু করে। রাতারাতি এ নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় নতুন এনজিও সংস্থা। বরিশালেও এরকম কয়েকটি এনজিও আছে যারা খাতা-কলমে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন অভিযান করলেও বাস্তবে তাদের দেখা মেলে না।

এর আগে গতবছর ১৫ অক্টোবর কীর্তনখোলা নদীর নাব্যতা সংকট দূর করতে খননের কাজ করতে গেলে রীতিমতো আতঙ্কিত পরিস্থিতি তৈরি হয় ড্রেজার চালকদের মধ্যে। ড্রেজার ভেঙে যাওয়া আতঙ্কে কাজ বন্ধ করে দেন তারা। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বারবার ময়লা আবর্জনার স্তূপ তুলে পরিষ্কার করে তারপর খনন চালাতে হয়। ঐ সময় বিআইডব্লিউটিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ভুঁইয়া বলেছিলেন, ড্রেজারের কাটারে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য আটকে যাওয়ায় মেশিন বন্ধ করে বারবার কাটার পরিষ্কার করতে হচ্ছে। এতে খননের সময় ও ব্যয় দুটিই বাড়ছে। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথগুলোর অন্তত ৩০টি স্থানে শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা–সংকটের আশঙ্কায় এসব স্থানে খননের উদ্যোগ নিতে হয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ)।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত এরকম কোনো উদ্যোগ চোখে পরেনি। তবে নদীতে যাত্রীবাহী বড় লঞ্চের চলাচল কম থাকায় বিষয়টি এখন আলোচনায় আসেনা বলে জানান লঞ্চের চুকানী বা মাস্টাররা।

তবে সচেতন মহলের দাবি পরিবেশের শত্রু পলিথিনের উৎপাদন, পাইকারি বাজারজাতকরণের ওপর কঠোরতা আরোপ করলেই পলিথিন ব্যবহার বন্ধ সম্ভব।

পরিবেশবিদ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী মোঃ রফিকুল আলম বলেন, ২০০২ সালের ১ মার্চ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন সরকার। তবে এ ক্ষেত্রে শতভাগ সফলতা দেখাতে পারেনি কোন সরকারই। উল্টো গত ২২ বছরে বেড়েছে এর উৎপাদন ও ব্যবহার।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বাইন বলেন, পলিথিনের কারনে নানা সমস্যার হচ্ছে, যেমন পরিবেশের ও মাটির ক্ষতির মূল কারণ হলো পলিথিন। আমাদের দাবি নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। এই পলিথিনের কারনে আজ র্কীতনখোলা নদীর সৌন্দর্য এখন বিলীনের পথে। ফলে অচিরেই তার চিরচেনা রূপ হারাবে বলে মনে করছেন নগরবাসী।

বরিশালের পরিবেশ ও সামাজিক আন্দোলনের নেতা কাজী মিজানুর রহমান বলেন, নদীতে যেমন পলি জমছে, তেমনি প্লাস্টিক বর্জ্য মাছের প্রজননের জন্য বড় একটি হুমকি। এজন্য সবার আগে কারখানা গুলোর উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, আমরা এই নদীর সৌন্দর্য বিলীন হতে দিবো না।  

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল জেলার সহকারী পরিচালক কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

অন্যদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক জহিরুল ইসলাম তালুকদার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর এক কথায় বলতে গেলে জেহাদ ঘোষণা করেছে। কিন্তু হাট-বাজারে পলিথিন বন্ধের বিরুদ্ধে দেখা যায় না তাদের।

বিআরইউ