অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে লিবিয়া হয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাবার পথে পঙ্গুত্ব নিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে স্বপনকে।
ভালো থাকা ও পরিবারের সবাইকে ভালো রাখার জন্য স্বপ্নের দেশ ইতালি যেতে পারেননি তিনি। উল্টো সারা জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে ফিরতে হয়েছে তাকে। পাশাপাশি দুর্বিষহ যন্ত্রণা ও নির্যাতন সহ্য করে ও লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ফিরতে পেরেছেন দেশে।
দেশে ফিরেও তাকে অসহায় জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ধারদেনা করে দালালদের হাতে ২৫ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। বর্তমানে স্বপন তার বাবা, স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার পাচখোলা ইউনিয়নের পশ্চিম পাচখোলা গ্রামের ওমর আলী সরদার ও হনুফা বেগমের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন স্বপন (৪০)। প্রায় ১৫ বছর আগে একই উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের রাজারচর গ্রামের জয়নাল বেপারী ও রাশিদা বেগমের মেয়ে মিনু বেগম (৩৫) এর পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। তাদের সংসারে দুটি সন্তান আছে। মেয়ে মোহনা আক্তার (১৩) স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। ছেলে সাঈদ (১০) স্থানীয় মাদ্রাসায় হাফেজী লাইনে পড়াশোনা করছে। স্বপনের এক বোন আছে, বিয়ে দিয়েছে। তাদের সংসারে বাবা ওমর আলী সরদার থাকেন। কিন্তু চোখে কম দেখা ও অসুস্থতার জন্য কোন কাজ করতে পারেন না।
স্বপনের টাকায় পুরো সংসার চলতো। প্রথমে তিনি মোটরসাইকেল ভাড়ায় যাত্রী আনা নেয়া করতেন। পরে একটি ইটভাটায় কাজ করতেন। সংসার তাদের মোটামুটি ভালোই চলছিলো।
আরও জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার তাতীবাড়ি এলাকার রড সিমেন্ট ব্যবসায়ী দালাল সোহাগ হোসেন ও একই উপজেলার মস্তফাপুর ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামের দালাল দেলোয়ার সরদারের সাথে পরিচয় হবার পর স্বপনকে ইতালি যাবার জন্য লোভ দেখান। তাদের ফাঁদে পড়ে দালাল দুইজনের সাথে ১২ লাখ টাকায় চুক্তি করেন।
প্রথমে দালাল সোহাগের কাছে ১২ লাখ ও পরে আরেক দালাল দোলোয়ার সরদারের কাছে ৩ লাখ টাকা দেন। এরপর প্রায় ১৫ মাস আগে স্বপ্নের দেশ ইতালি যাবার জন্য বাড়ি থেকে বের হন স্বপন। এরপর দুবাইতে দালালদের একটি ক্যাম্পে ৫ দিন থাকেন। পরে লিবিয়াতে তাকে আনা হয়। সেখানে আনার পর শুরু হয় অত্যাচার। প্রায় তিন মাস চলে অত্যাচার, পুলিশে ধাওয়া ও পরে জেলহাজতে যেতে হয়।
২৮ দিন লিবিয়াতে জেলহাজতে থাকতে হয়েছে স্বপনকে। এরপর ইতালি যাবে এমন বিভিন্ন দেশের ১২৮ জনকে একটি ভবনে রাখা হয়। একরাতে পুলিশ ঐ ভবনে রেড দেন। এ সময় অনেকেই ভয়ে দোতালার ছাদ থেকে লাফ দেন। স্বপনও পুলিশের হাতে ধরার পরার ভয়ে লাফ দেন। সেই লাফই তার জীবনের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। নিচে পড়ে যাবার পর আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি তিনি। স্থানীয় একজনের সহযোগিতায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর দালাল সোহাগ ও দেলোয়ার আর কোন খোঁজ রাখেনি স্বপনের। স্বপন একটু সুস্থ হলে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে সব জানান। তখন তার স্ত্রী দালালদের কাছে গেলে, স্বপনের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান। কিন্তু এরপর দালালরা আর কোন খোঁজ নেননি স্বপনের।
পারিবারিক সূত্রে আরও জানা যায়, কোন উপায় না পেয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আরেক দালালের সন্ধান পান স্বপনের স্ত্রী মিনু বেগম। মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়ের পখিরা গ্রামের দালাল সাগর মল্লিকের সাথে স্বপনের স্ত্রী মিনু বেগমের কথা হয়। ঐ দালাল জানান স্বপনকে দ্রুত দেশে আনার ব্যাবস্থা করা হবে। তার জন্য ১০ লাখ টাকা চুক্তি হয়। ধারদেনা, লোন ও মিনুর তার বাবার বাড়ির জমি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেন। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয়নি। অসুস্থ অবস্থায় কোন রকম ওষুধ ছাড়াই স্বপনকে ফেলে রাখা হয় একটি ঘরের টয়লেটের পাশে ছোট একটি জায়গায়। কোনদিন খেতে দিতো আবার দিতো না। মেরুদন্ড ও হাত পা ভেঙ্গে যাওয়ার প্রচন্ড ব্যাথায় চিৎকার করলেও তাকে একটি ওষুধ দেয়া হতো না। এভাবে যায় দীর্ঘ ছয় মাস। এরপর তাকে অক্টোবরের ১১ তারিখে দেশে আনা হয়। এয়ারপোর্ট থেকেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে তাকে মাদারীপুরের নিজ বাড়িতে আনা হয়। টাকার অভাবে তার উন্নত চিকিৎসা করাও সম্ভব হচ্ছে না।
তাছাড়া তিনি হাঁটা তো দুরের কথা উঠে বসতেও পারেন না। সারাদিন বিছানায় সুয়ে থাকতে হয়। একমাত্র উপার্জনসক্ষম ব্যক্তির এই করুণ অবস্থা হওয়ায় পুরো পরিবার ভেঙ্গে পড়েছেন। তারা খেয়ে, না খেয়ে কোন রকমভাবে জীবন যাপন করছেন। আগামীতে তাদের কিভাবে দিন যাবে, তা তারা জানেনা। স্বপ্নের দেশ ইতালীতে অবৈধভাবে যাবার পথে আজ তারা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। শুধুমাত্র থাকার জন্য বাড়িটি ছাড়া আজ তাদের কিছুই নেই। উল্টো ধার-দেনা আর কিস্তির টাকার জন্য দিশেহারা হয়ে পড়েছে পরিবারটি।
এ ব্যাপারে তার স্ত্রী মিনু বেগম বলেন, দালাল সোহাগ ও দেলোয়ার তারা কেউ আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ করছে না। টাকা ফেরত চাইলে তাও দিচ্ছে না। আরেক দালাল সাগর মল্লিকে ১০ লাখ টাকা দেই। সাগরের দুলাভাই আশরাফ দুবাই থাকেন। আর আশরাফের ভাই বাহার লিবিয়াতে থাকেন। তাদের মাধ্যমে অসুস্থ স্বপনকে দেশে আনার কথা হয়। কিন্তু তারা দীর্ঘ ছয় মাস ঘুরিয়ে তবেই স্বপনকে দেশে এনেছে। আমার স্বামী এখন বিছানা থেকে উঠতে পারে না। হাটতে পারেনা। মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রয়োজন থেরাপী দেয়ার। কিন্তু টাকার জন্য কিছুই করতে পারছিনা। স্বপনের টাকাতেই চলতো সংসার। সেই মানুষটি আজ ইতালী যাবার পথে অকেজো হয়ে গেছে। এখন তার চিকিৎসা তো দুরের কথা ঠিকমতো খেতেই পারিনা। আর এই দুই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা কিভাবে করারো। আমাদের পুরো সংসার আজ শেষ হয়ে গেলো। আমি দালালদের বিচার চাই। আর সকলের সহযোগিতা চাই। যাতে করে স্বপনকে একটু চিকিৎসা করাতে পারি।
অসুস্থ স্বপনের মেয়ে মোহনা আক্তার বলেন, আমরা বাবাকে এভাবে আমরা দেখতে পারছিনা। অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমরা দালালদের বিচার চাই।
অসুস্থ স্বপনের শাশুরি রাশিদা বেগম বলেন, দালাল সোহাগের কথায় তার কাছে টাকা দেয়া হয়েছে। এখন টাকা ফেরত দিচ্ছে না। আমার মেয়ে মিনু তার স্বামীর জন্য নিজের জমি বিক্রি করে, ধার দেনা করে টাকা দিয়েছে। এখন ওদের কি হবে। দালাল যদি টাকাগুলো ফেরত দিতো, তাহলেও কিছুটা হলেও উপকার হতো।
এ ব্যাপারে দালাল সোহাগের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোনে বলেন, স্বপনের পরিবার আমার কাছে কোন টাকা পয়শা দেয়নি। টাকা দিয়েছে দেলোয়ার সরদারের কাছে। দেলোয়ার সরদারকে জিজ্ঞেস করেন, তিনিই সব জানেন।
দালাল দেলোয়ার সরদারের মোবাইল ফোনে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া গেছে। তাই তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
মাদারীপুরের সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আফজাল হোসাইন বলেন, তারা যদি সহযোগিতার জন্য দরখাস্ত দেন, তাহলে তাদের চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করা হবে। তাছাড়া থেরাপী দিতে চাইলে, সরকারীভাবে বিনা টাকায় সমাজসেবা থেকে দিতে পারবেন। আর প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য দরখাস্ত করলে, তাও করে দেয়া যাবে।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। তিনি যদি সহযোগিতা চান, তাহলে তার চিকিৎসার জন্য সমাজসেবা থেকে ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।
ইএইচ