রেলওয়েতে ভ্রমণকারী বিনা টিকেটের যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হয় ভাড়া অথবা জরিমানার টাকা। আদায় করা এই অর্থ রেলওয়ের কোষাগারে জমা না দিয়ে প্রায় পুরোটাই আত্মসাৎ করছেন কতিপয় রেল কর্মকর্তা-কর্মচারী। এতে প্রতিনিয়ত রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, ফলে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না লোকসানে থাকা জনগণের যাতায়াতের জন্য সরকারি এই সেবা খাত।
সূত্র জানায়, বিনা টিকেটে রেলওয়েতে ভ্রমণ করলে আছে জরিমানা সহ ভাড়া আদায়ের বিধান। বিনা টিকেটে ভ্রমণ করলে কেউ কেউ প্রকৃত ভাড়া দিয়ে রশিদ বা টিকেট নেন। কিন্তু রেল কর্মীদের হাতে প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে কম টাকা দিয়েই ভ্রমণ করতে পারেন বলে টিকেট না কেটেই ট্রেনে উঠে ভ্রমণ করেন অনেক যাত্রী।
লালমনিরহাট জেলা শহরের মুদি দোকানদার শাহীন মিয়া বলেন, প্রায় সময়ে লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকা, বগুড়া যাই। টিকেট না কাটলে অ্যাটেন্ডেন্ট কিংবা টিটিই টাকা নেন, কিন্তু কোনো রশিদ দেন না। সে টাকা সরকারের কাছে জমা হয় কি না তা বলতে পারি না।
একই শহরের চাকুরিজীবী রফিকুল ইসলাম বলেন, অনেক সময় টিকেট পাওয়া না গেলেও যাতায়াতের জন্য ট্রেনে উঠে পড়ি। টিটই এসে টিকেট চাইলে বলি টিকেট নেই। তখন আমার মত অনেক যাত্রী তাদের হাতে টাকা দেয়, মাঝে মাঝে রশিদ দিলেও অধিকাংশ সময় তারা কোনো প্রকার রশিদ বা টিকেট দেন না।
ট্রেনে নিয়মিত ভ্রমণ করা আরও অনেকে জানান, বিনা টিকেটে ভ্রমণ করলে সাধারণত টিকেটের নির্ধারিত মূল্যের থেকে কম টাকা দিলেই যাতায়াত করা যায়। ফলে তারা টিকেট কাটতে চান না।
যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা এসব অর্থ রেল কোষাগারে জমা না দিয়ে প্রায় পুরোটাই পকেটস্থ করছেন রেলের কর্মচারীরা, যার একটা অংশ যাচ্ছে কর্মকর্তাদের পকেটেও। সম্প্রতি টিকিট বিহীন যাত্রীর কাছে টাকা নেওয়ার একটি ফুটেজ ফাঁস হয়।
ফাঁস হওয়া ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, টিকেটবিহীন এক যাত্রীর কাছ থেকে রেলওেয়ের দুই অ্যাটেন্ডেন্ট টাকা নিচ্ছেন রশিদ না দিয়েই। বিষয়টি নিয়ে লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডিভিশনাল ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন) তাসরুজ্জামান বাবুর কাছে সাংবাদিকরা গেলে তাঁদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।
এদিকে ফাঁস হওয়া ভিডিও ফুটেজের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামলে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। একাধিক অ্যাটেন্ডেন্টের কাছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে (ভিডিও ও অডিও রেকর্ড সংরক্ষিত) তারা জানান, লালমনিরহাট রেল বিভাগের অধীনে লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশনের জন্য অ্যাটেন্ডেন্ট রয়েছেন ১৪ জন পার্বতীপুরে ১৪ থেকে ১৫ জন এবং সান্তাহারে রয়েছেন ৬ জন। প্রতিটি ট্রেন থেকে অনিয়মের মাধ্যমে (রশিদ না দিয়ে টাকা গ্রহণ) যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকার একটি অংশ দিতে হয় ডিএমই অফিস, হেড টিএক্সআর অফিস ও এ্যাকাউন্টস অফিসকে। জনপ্রতি এ্যাটেনডেন্টকে ১৩ শত থেকে ১৫ শত টাকা দিতে হয়। তারা আরও জানান, ডিএমই- এর পক্ষে ওই অফিসের টিএক্সআর উজ্জল মাহমুদ এই টাকার ভাগ নেন।
এসব বিষয়ে জানতে লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন) তাসরুজ্জামান বাবু`র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের সাথে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থাপক লিয়াকত শরীফ খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, "রশিদ ছাড়া যাত্রীরা কেনো টাকা দিবে"। একথা বলেই তিনি কলটি কেটে দেন। পরে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।
সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, রেলের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের কারণে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে সরকারি এই সেবাখাতকে। যা প্রতি বছর গড়ে দুই হাজার কোটি টাকার সমান।
সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য ও সিনিয়র সাংবাদিক আবু হাসনাত রানা বলেন, কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে রেলওয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। রেলওয়ের আয় বাড়ানো এবং সরকারের অর্থের অপচয় রোধে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
বিআরইউ