চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী ও রামু হয়ে কক্সবাজারের ১৮ হাজার কোটি টাকার রেল প্রকল্পে আগাগোড়া গলদ।
কক্সবাজার স্টেশনে ৩৯ কক্ষের হোটেল ফাঁকা পড়ে আছে। ৪৪০ কোটি টাকার অডিট আপত্তি রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে করা এই প্রকল্পের অনিয়ম দুর্নীতির সাথে সাবেক রেলমন্ত্রী ও শীর্ষ আমলারা জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ৫ ও ৬ নভেম্বর রেললাইন এবং আইকনিক স্টেশন পরিদর্শনে যান রেল পরিদর্শন অধিদপ্তরের জিআইবিআর প্রধান ইঞ্জিনিয়ার ফরিদ আহমেদ পরিদর্শন করেন।
তিনি ব্যাপক অনিয়ম পেয়েছেন বলে দৈনিক আমার সংবাদকে জানিয়েছেন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রেলপথটিতে পর্যাপ্ত সেতু, কালভার্ট নির্মাণ না করায় গত বছর সাতকানিয়া, লোহাগাড়া এলাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়। রেলপথটি নির্মাণের সময় স্থানীয়দের মতামতকে উপেক্ষা করার অভিযোগ রয়েছে।
বন্যা-পরবর্তী সময়ে রেলওয়ে স্থানীয়দের দাবির মুখে আরও ৪টি কালভার্ট নির্মাণ করলেও ওই এলাকায় এখনো বন্যার ঝুঁকি রয়ে গেছে।
একই চিত্র দেখা যায় রেলপথ নির্মাণের পাহাড়ি এলাকায় রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণের ক্ষেত্রেও। রেলপথের উভয়পাশে শক্তিশালী ও উঁচু রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণ না করায় বর্ষা মৌসুমে রেললাইনে পাহাড় ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। রিটার্নিং ওয়াল নীচু হওয়ার পাশাপাশি ওয়ালের পকেট গেটগুলো অরক্ষিত রাখায় রেললাইনের ওপর হাতিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী উঠে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।
সর্বশেষ বর্ষা মৌসুমে এই রেলওয়ে স্টেশনের ওপর থেকে পানি চুঁইয়ে স্টেশনের ভেতরে প্রবেশ করেছে। প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রেলওয়ে স্টেশন ভবনে পানি প্রবেশের ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় হয়েছে।
অন্যদিকে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নয়টি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বর্ষার সময় পানি প্রবেশের ঘটনা ঘটছে। রেললাইনটি চালুর এক বছর পার হওয়ার আগেই ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ গেছে অন্তত ১২ জনের। হাতিসহ মৃত্যু হয়েছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণিরও।
লাইনটির নানা ত্রুটি নিয়ে গত ১৭ অক্টোবর রেলওয়েকে চিঠি দিয়েছে বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগ।
এতে বলা হয়, ২০১৯ সালের প্রজ্ঞাপন অনুসারে বন্যপ্রাণির চলাচলে আন্তর্জাতিক মানের ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করতে হবে। রেললাইনটিতে সাউন্ড ব্যারিয়ার নির্মাণের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। বনাঞ্চলে হাতির চলাচল নির্বিঘ্ন করতে তিনটি আন্ডারপাসের মধ্যে নির্মাণ হয়েছে মাত্র একটি, তাও সরু। এ ছাড়া উচ্চতা এত কম, দেখলে মনে হয় কালভার্ট। এতে বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক চলাচল ও বসবাস ব্যাহত হচ্ছে। আবার বনাঞ্চল দিয়ে ট্রেন চলাচলে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও মানা হচ্ছে না।
এদিকে রেলের সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় স্টেশন এই কক্সবাজারেই। বৃষ্টি হলে ঝিনুক আকৃতির স্টেশনটির ছাদ থেকে এখনই চুঁইয়ে পড়ে পানি। ড্রেন উপচে প্লাবিত হয় প্ল্যাটফর্ম। অথচ স্টেশনটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ২১৫ কোটি টাকা।
দেশের সর্ববৃহৎ পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপনের দাবি অনেক বছরের। চট্টগ্রামের দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইনও ছিল। পরে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন করা হয়। ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে এ রুটে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
উল্লেখ্য, চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড দুই ভাগে কাজ করেছে।
প্রাণিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন পিপল ফর এনিম্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান স্থপতি রাকিবুল হক এমিল বলেন, বন্যপ্রাণির জন্য নিরাপদ করতে যেসব শর্ত মেনে রেললাইনটি নির্মাণের কথা ছিল, রেলওয়ে তা করেনি। স্বাভাবিকভাবেই এই রেললাইন বন্যপ্রাণির জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে। বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগও পড়েছেন বিপদে।
সংস্থাটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, বনাঞ্চলে রেললাইন স্থাপনে বেশ কিছু নিয়মকানুন মানার কথা ছিল রেলওয়ের। তারা তা না করায় বন্যপ্রাণির জন্য স্বাভাবিক জীবন ও বিচরণে সমস্যা হচ্ছে।
ইএইচ