সুনামগঞ্জের ছাতক রেলওয়ের কর্মকর্তার চেয়ার দখলে নিয়েছেন শ্রমিক লীগ নেতা আব্দুল নুর। তিনি রেলওয়ে সিলেট শাখার শ্রমিকলীগের প্রধান উপদেষ্টা ও শ্রমিকলীগের সাবেক সহ সভাপতি। আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক এর নাতিন জামাই পরিচয়ে ছাতক-ভোলাগঞ্জ রেলওয়ে সম্পদ লুটপাট চালানোর মূলহোতা হচ্ছেন এই আদুল নুর।
ইতিমধ্যে রেলওয়ের সম্পদ লুটপাটের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদনে আব্দুল নুরকে অভিযুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হলেও তিনি আছেন বহাল তবিয়তে।
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে আব্দুল নুরকে একাধিকবার বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হলেও এমপির ডিও লেটারে বারবার ফিরে আসেন ছাতকে। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগের পরও রহস্যজনক কারণে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আব্দুল নুরের শিক্ষাগত যোগ্যতা ৫ম শ্রেণি পাস। তিনি খালাসী পদ থেকে হয়েছেন ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী ২য় শ্রেণি কর্মকর্তা। বর্তমানে আছেন বিআর, সিএসপি, ভোলাগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে।
ছেলে-মেয়ে আত্মীয়স্বজনের নামে করেছেন কয়েক কোটি টাকার বাড়ি, গাড়ী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। স্থানীয়দের অভিযোগ, গত ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর রেলওয়ের কর্মকর্তা ও তার ভগ্নীপতি, আরএনবি সদস্য, বিজিবি ও পুলিশের যোগসাজশে ভোলাগঞ্জ বাংকার এলাকায় কয়েক শত কোটি টাকার মেশিনারিজ মালামাল, পাথর লুটপাট করা হয়েছে।
গত ৩ জানুয়ারি রেলওয়ের মহা পরিচালক আফজাল হোসেন`সহ কর্মকর্তারা ছাতকে স্লীপার প্লান পরিদর্শন কালে স্থানীয় সাংবাদিকরা ভোলাগঞ্জের লুটপাটের সাথে রেলওয়ে কর্মকর্তা আব্দুল নুর ও তার ভগ্নিপতি, আরএনবি সদস্য জড়িত থাকার বিষয়ে অবহিত করে লুটপাটের ঘটনায় মামলা না করার কারণ জানতে চাইলে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি রেলওয়ের মহা পরিচালক।
গত ৮ জানুয়ারি মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে আব্দুল নুর ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী ভারপ্রাপ্ত ও প্রধান সহকারী সুরঞ্জন পুরকায়স্থকে ছাতক থেকে দ্রুত বদলি করনসহ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এডিজি আই’কে নির্দেশ দেন। এডিজি আই মহাপরিচালকের নির্দেশ বাস্তবায়ন করার জন্য প্রধান প্রকৌশলী চট্টগ্রাম দপ্তরে প্রেরণ করলে তা কার্যকর না করে আব্দুল নুরের মোবাইল ফোনে পাটিয়ে দিয়েছেন প্রকৌশলী দপ্তরের কোন এক কর্মচারী। গোপন নথি হাতে পাওয়ার পর আব্দুল নুর বদলির বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ভাবে তদবির শুরু করেছেন। মহা পরিচালকের নির্দেশের একমাস অতিবাহিত হলেও বদলির কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় ও গোপন নথি ফাঁসের ব্যাপারে সর্বমহলে চলছে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড়।
২য় শ্রেণির কর্মকর্তা আব্দুল নূর ছাতক শহরের বাগবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণি পাশ করে ১৯৮৬ সালে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী (ইলেকট্রিক খালাসী) হিসাবে ছাতক রেলওয়েতে চাকুরিতে যোগদান করেন। ১৯৯৩ সালে কার্পেন্টার হেল্পার ২০১১ সালে ওয়ার্ক সুপারভাইজার পদে পদোন্নতির পর বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির ও রেলওয়ের স্লীপার, লোহা, পাথর চুরি করে বিক্রির অভিযোগে ঢাকায় বদলী করা হয়। ২০১৪ সালে ফের ছাতকে বদলী হয়ে আসেন।
পরবর্তীতে রোপ লাইন (টিএলআর) অস্থায়ী কর্মচারীর বেতন আত্মসাত ও ভোলাগঞ্জের পাথর চুরির অভিযোগে ২০১৫ সালে জামালপুরে বদলি করা হয়। ২০১৬ সালে জামালপুর হতে সিলেট বদলি হন। ২০১৮ সালে দলীয় প্রভাব কাটিয়ে এমপির ক্ষমতা বলে ওয়ার্ক সুপারভাইজার ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হিসাবে ফের ছাতকে বদলি হন। ২০১৯ইং সালে ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে ও সিএসপির (অতিরিক্ত দায়িত্ব) গ্রহণ করেন। ছাতকের অতিরিক্তের উপর অতিরিক্ত তিন দায়িত্ব গ্রহণের পর আব্দুল নুর এর ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। হাতে পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ। ছাতক রেলওয়ের বাসা বাড়ি, দোকান কোঠা, নদীর পারের ড্রাম্পিং সাইট ভাড়া দিয়ে, ভোলাগঞ্জের পাথর বিক্রিসহ সিএসপির চেম্বার মেরামতের নাম করে ৩২ লাখ টাকার টেন্ডারের কাজ অন্যের নামে ভাগিয়ে নিয়ে সামান্য ঘষা মাজা করে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাত করেন। বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০২০ সালে আব্দুল নুরের ছেলে মাহবুবুর আলমকে ভৈরব, মেয়ে সুর্বনা আক্তারকে আখাউড়া, কামাল উদ্দিনকে চট্টগ্রাম ২০২১ সালে আব্দুল নুরকে চাঁদপুর, সুরঞ্জন পুরকায়স্থকে চট্টগ্রাম বদলি করা হয়।
আব্দুল নুর ২০২২ সালে উপ-সহাকারী প্রকৌশলী পদে পদ্দোন্নতি পেয়ে চাঁদপুর থেকে সিলেটে বদলী হওয়ার পর বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে অসদাচরণ করার কারণে ৬ মাসের মধ্যে আবার চাঁদপুরে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। তবে আব্দুল নুর চাঁদপুর যোগদান না করে বীর দর্পে সিলেট-ছাতকে ঘুরে বেড়ান। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে আব্দুল নুরের বিরুদ্ধে একটি গোপনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আব্দুল নুর ছাতক বাজার দায়িত্ব থাকাকালীন সময় সুরমা নদীর পারের স্টককৃত মালামাল, বিআর এন্ড সিএসপির গোডাউনের মালামাল, ভোলাগঞ্জেরে পাথর, বালি বিক্রি করে, নদীর পার, রেলওয়ের বাসা বাড়ি,দোকান কোটা ভাড়া দিয়ে ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ পয়েন্টে রেলওয়ের জমিতে মার্কেট নির্মাণ করিয়া দোকান কোঠা বিক্রি করে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ লুট করে আর্থিক ভাবে লাভবান হয়ে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। গাড়ি নম্বর ১১-৬১৬৬, ২০-০২০৩, ১৮-৯৪২৬, ১৬-৯৫৩৮, ১১-০৩৪১, ১৮- ৮৬৫৮, ২২-৬৫৬৩ ট্রাকসহ অন্তত ১২টি মটরযান এবং ২টি নতুন ব্যান্ডের দামি মোটরসাইকেল মালিক হয়েছেন। আব্দুল নুরের গ্রামের বাড়ি হাওর অঞ্চল হওয়ায় ফাউন্ডেশন বাবদ অনেক টাকা খরচ করে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করছেন। আব্দুল নুরের মেয়ে সুর্বনা আক্তারকে আখাউড়া ও ছেলে মাহবুবুল আলমকে ভৈরব বাজারে বদলি করা হলে যোগদান করার পর বদলিকৃত কর্মস্থলে এখন পর্যন্ত অনুপস্থিত রয়েছেন। মাহবুবুল আলম সরকারের বিনা অনুমতিতে রেলওয়ের চাকুরীতে অনুপস্থিত থাকিয়া মাহবুব এন্টারপ্রাইজ, সিদ্দিক ট্রেডার্স এবং সিলেটের দক্ষিণ সুরমা বাইপাস সড়কে মাহনুর ট্রেডার্স নামে একটি পার্সের দোকানসহ ৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। জেলা ট্রাক পিকআপ কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক পদের দায়িত্বে আছেন বলে জানা গেছে।
২০২১ সালের পর আব্দুল নুরকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হলেও ছাতক সিএসপি, বিআর গোডাউনের চাবি ও গুরুত্বপূর্ণ ফাইলপত্র আব্দুল নুর নিজের কাছে রেখে দেন। গোডাউনের চাবি ফাইল পত্র আব্দুল নুরের কাছে থাকায় সময়মতো স্লীপার তৈরি করাসহ দাপ্তরিক কাজে মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। এর ফলে সরকারি এই প্রতিষ্টান আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাহাড় সমান এতো অভিযোগ থাকার পরও স্থানীয় এমপির ডিও লেটার দিয়ে তদবির করে দলীয় প্রভাব কাটিয়ে ২০২৪ সালে ফের ছাতকে ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) হিসাবে ছাতকে যোগদান করেন।
ছাতকে যোগদান করার পর বিআর গোডাউনের লোহ জাতীয় মালামাল সিএসপিতে স্থানান্তরের নাম করে কয়েক লাখ টাকার মালামাল পুরাতন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রি করে দেন। স্লীপার তৈরির ভাঙ্গা পাথর সিমেন্টের খালী বস্তায় ভরে দুই ট্রাক পাথর গ্রামের বাড়ি নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও ১২জন টিএলআরকে ৭ হাজার টাকা বেতনে রাখা হলেও তাদের প্রতিমাসে মাত্র ৫/৬ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকা নিজের পকেটে রাখছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আব্দুল নুর প্রায় প্রতি মাসেই সিএসপিতে কর্মরত-কর্মচারীদের নামে এবং নিজের নামে প্রতিমাসে ভুয়া টেবিল তৈরির মাধ্যমে সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করারও অভিযোগ আছে। অভিযোগের বিষয়ে আব্দুল নুর বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট ভিত্তিহীন। একটি কু-চক্রিমহল আমার পিছনে এসব ছড়াচ্ছে। রেলওয়ের মহাপরিচালক, মো. আফজাল হোসেন ও প্রধান প্রকৌশলী,পূর্ব, চট্টগ্রাম আবু জাফর মিয়া ফোন রিবিচ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায় নি।
বিআরইউ