কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনার নাম ফিশারি ঘাট।৩৬ জুলাইয়ের পূর্বে আওয়ামী লীগের একক নিয়ন্ত্রণে ছিল।তা এখনো বহাল তবিয়তে আছে।আগে নেতৃত্ব ছিলো বাবুল সরকার নূর হোসেন ও প্রবীর।তারা মৎস্যজীবী লীগের সাইনবোর্ডে ছিলেন।তারা ছাত্রজনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। জুলাই পরবর্তী নতুন সরকার আসার পর বাবুল সরকারে জায়গায় আরে মৎজীবীলীগ নেতা মোহাম্মদ আলী নামে একজনকে বসিয়েছেন।
তিনিও অনেক অভিযোগে অভিযুক্ত।বাকী দুইজন প্রবীর ও নূর হোসেনের বেপরোয়া দাপট দেখলে মনে হয় বর্তমান সরকার তাদের পকেটে।ফিশারি ঘাটের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখা যাওয়ার পরও কেন উচ্ছেদ হচ্ছেনা বুঝে উঠতে পারছেনা সংশ্লিষ্টরা।চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন,এখন আর উচ্ছেদে কোনো বাধা নেই।ফিশারি ঘাট থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ নিয়ে শুরু থেকে কাজ করছেন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা। এখন তাদের কোন আওয়াজ দেখা যাচ্ছেনা।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগর আহ্বায়ক আরিফ মঈনুদ্দিন ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সদস্য সচিব তৌহিদুল ইসলাম সাঈদ বলেন,আমাদের একটি অংশ ফিশারি ঘাটের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও চাঁদাবাজি নিয়ে প্রথম থেকে কাজ করে আসছে।খুব দ্রুত জেলা প্রশাসকের সাথে বসে সিদ্ধান্তে যাবো।উল্লেখ্য কর্ণফুলী নদীর পাশে গড়ে উঠা ফিশারি ঘাট বাজারে গত তিন বছর আগে একটি মসজিদ নির্মাণ করে সোনালী যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতি। যাতে প্রশাসন ধর্মীয় স্থাপনা দেখে সে এলাকায় যাতে উচ্ছেদ কার্যক্রম না চালায়। যদিও আশপাশের এলাকায় আরও কয়েকটি মসজিদ রয়েছে। নির্মাণ করা মসজিদের পাশে তৈরি করা হয় জেলেদের জন্য বিশ্রামাগার।
এরপরও নদী দখল করে নতুন মাছবাজার বা ফিশারি ঘাট গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। নদী রক্ষা কমিশনও বলছে নদী দখল করে গড়ে ওঠা বাজার অবৈধ। এ নিয়ে আদালতে একাধিক মামলাও চলমান। কিন্তু এরপরও ওই বাজারে নতুন করে গড়ে উঠছে অবৈধ অস্থায়ী স্থাপনা। সর্বশেষ গত ৩ মার্চ উচ্চ আদালতে চলমান মামলার নিষ্পত্তি হয়। এখন উচ্ছেদে আর কোনো বাধা নেই বলে জানায় জেলা প্রশাসন।
সম্প্রতি ফিশারি ঘাট এলাকায় গিয়ে এবং প্রশাসনের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
এদিকে গত বছরের (২০২৪) ২৯ মে উচ্চ আদালতের আদেশ বাজারের বিপক্ষে যায়। পরবর্তীতে খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আপিলেট ডিভিশনে সিভিল পিটিশন দায়ের করলে তা ‘স্ট্যাটাস কিউ’ ক্রমে শুনানির জন্য চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি ধার্য করা হয়। সর্বশেষ গত ৩ মার্চ আপিলেট ডিভিশন শুনানিতে উক্ত মামলাটি নিষ্পত্তি হয় এবং রিট পিটিশন বাস্তবায়নে কোন বাধা নেই মর্মে বিজ্ঞ ‘এওআর’ সার্টিফিকেট দাখিল করেন।
তবে গত সোমবার (১০ মার্চ) স্থানীয় একটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় সোনালী যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতি লিমিটেড। সেখানে চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত একটি পত্রে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানান, ‘কর্ণফুলী নদীর তীরে অবৈধ দখল উচ্ছেদ এর নির্দেশনা চেয়ে হিউম্যান রাইটস্ এন্ড পীস বাংলাদেশ-২০১০ সালে হাইকোর্টে একটি রিট ফাইল করেন। গত ২০১৫ সালের ৬ জুন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম বন্দর ও নৌ-বাহিনীর ছয়টি স্থাপনা সহ ২১৮৭টি স্থাপনা রয়েছে বলে প্রতিবেদন দাখিল করেন। মহামান্য হাইকোর্ট গত ২০১৬ সালের ১৬ই আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দর ও নৌ-বাহিনীর ৬টি স্থাপনা বাদ দিয়ে বাদবাকি ২১৮১টি স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশনা প্রদান করে রায় দেয়। বাকলিয়া মৌজার বি.এস ৮৬৫১ দাগের প্রায় চার একর জমির উপর বন্দর কর্তৃপক্ষ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণ করে বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডকে ১৫ বৎসরের জন্য ইজারা প্রদান করেন। উক্ত বি.এস দাগের ভ‚মি ১নং খতিয়ানভুক্ত হওয়ায় জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভ‚মি হিসেবে মালিকানা দাবি করেন। ফলস্বরূপ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসকের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে বীজ ১ম যুগ্ম জেলা জজ আদালত, চট্টগ্রাম-এ মালিকানা নিষ্পত্তির জন্য একটি মামলা রুজু করেন, যাহার মামলা নং-৪৮৪৫/২৩। উক্ত মামলাটি আগামী মে মাসের ২৫ তারিখ (২৫.০৫.২০২৫ইং) শুনানির জন্য দিন ধার্য্য আছে।
তাছাড়া লিভ-টু-আপীল সিপি-২৩৩/২০২৫ অনুযায়ী মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ আগামী ছয় মাসের মধ্যে নিম্ন আদালতে জায়গার মালিকানা সংক্রান্ত পেন্ডিং মামলাটি নিষ্পত্তি করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। উপরোক্ত মহামান্য হাইকোর্টের মামলা নং- ২৪০২/২০২৩ অনুযায়ী ইতিপূর্বে জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রদত্ত উচ্ছেদের নোটিশকে অবৈধ ঘোষণা করা হইয়াছে। সম্প্রতি আমার মক্কেল বিশ্বস্ত সূত্রে জানিতে পারেন যে, জেলা প্রশাসক মহোদয় বিশেষ স্মারকে সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) বাকলিয়া সার্কেলকে বিরোধীয় ভ‚মি হইতে বন্দর কর্তৃক ইজারাদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করার জন্য নির্দেশ প্রদান করিয়াছেন, যাহা দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপনের সামিল। কেননা দেশের যে কোন আদালতে মালিকানা বা বিরোধ সংক্রান্তে কোন মামলা-মোকদ্দমা চলমান থাকাবস্থায় উহার চূড়ান্ত আদেশ ব্যতিরেকে কোন নির্বাহী বিভাগ কোন উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করিতে পারেন না। এমতাবস্থায় উপরোক্ত বর্ণনার প্রেক্ষিতে মহোদয়কে দেশের প্রচলিত আইনকানুন অনুসারে যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণে বিনীত অনুরোধ করছি।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমরা এখনও সোনালী যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতিকে কোন চিঠি ইস্যু করিনি। তাছাড়া গত ৩ মার্চ আপিলেট ডিভিশন শুনানিতে উক্ত মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে। আমরা বাকলিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাদেরকে কোন চিঠি দিয়েছে কি না, তা জানা নেই। হয়তো উচ্ছেদের বিষয়ে তারা কারও সূত্রে জানতে পেরে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।’
সোনালী যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা বন্দর থেকে ১৫ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছি। জেলা প্রশাসনের ১নং খাস খতিয়ানের জায়গা আছে অল্প। প্রয়োজনে তাদের জায়গা তারা বুঝে নিয়ে যাবে। কিন্তু বন্দরের জায়গায় কেন উচ্ছেদ পরিচালনা করবে ? আমরা মাছ ব্যবসা পরিচালনা করে জীবিকা নির্বাহ করি। কেন আমাদের ব্যবসার ক্ষতি করা হবে ? এখন আমাদের উচ্ছেদ করা হলে আমাদের ইজারার কী হবে ?এখন যদি ডিসি দাবি করেন, সেটা উনার জায়গা। তবে প্রয়োজনে উনাকে ইজারা দিয়ে আমরা ব্যবসা পরিচালনা করব।’
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এবং সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর এই বাজারের প্রবেশমুখে নতুন করে এই স্থাপনা নির্মাণ করে সোনালি যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতি। বাঁশ, টিন ও প্লাস্টিক দিয়ে নির্মাণ করা হয় এই স্থাপনা। এছাড়া বাজারের পেছনের দিকেও কয়েক মাস আগে কিছু অস্থায়ী স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সেগুলোতেও চা দোকান, পান দোকান গড়ে তোলা হয়। এ ছাড়া মাছের টুকরি, ভ্যান ইত্যাদি রাখা হচ্ছে এসব স্থাপনায়। নতুন করে এসব স্থাপনা গড়ে তোলার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানছে না তারা। ২০২৪ সালের ৯ অক্টোবর জেলা প্রশাসন মাইকিং করে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলে। কিন্তু এতেও কোনো টনক নড়েনি তাদের।
মৎস্যজীবী সমিতি এখনও বাজারটিতে নতুন নতুন স্থাপনা তৈরি করে যাচ্ছে। বাজারে ঢোকার ফটক পেরিয়ে সামনে গেলেই ডান পাশে নদীর পাড়ে বাঁশ টিন দিয়ে স্থাপনা তৈরি করা হয়। ওখানে সকালে মাছ বেচাকেনা চলে। আগে সেখানে খালি ছিল। এ ছাড়া পেছনের অংশে দক্ষিণ পাশে যে অস্থায়ী স্থাপনাগুলো করা হয়, সেগুলো কয়েক মাস আগের। জেলেদের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা, মসজিদসহ নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়।
দক্ষিণ পাশে কয়েক বছর আগে থেকেই তারা নানা স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করে আসছিলেন তারা। এর আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাজারের পেছনের অংশে বা দক্ষিণে ইট দিয়ে স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করেছিল। তখন তা ভেঙে দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। এরপর আস্তে আস্তে অস্থায়ী স্থাপনা তৈরি করা হয় সেখানে। তখন সোনালি যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বাবুল সরকারের বিরুদ্ধে এই দোকান নির্মাণের অভিযোগ উঠেছিল। তিনি আবার বাংলাদেশ আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি। এতোদিন বাজারের আইনগত এবং পরিচালনা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম দেখাশোনা করতেন বাবুল সরকার।
৫ আগস্টের পর থেকে তাঁকে বাজারে তেমন একটা দেখা যায় না। সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী ও উপদেষ্টা নুর হোসেন এখন সবকিছু দেখাশোনা করেন।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, হাইকোর্ট থেকে যেহেতু মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, তাহলে প্রশাসন চাইলে যে কোনো সময় উচ্ছেদ করে নদী দখল থেকে রক্ষা করতে পারবে। নদী কমিশন আগে থেকে বলে আসছে বাজারটি নদী দখল করে করা হয়েছে। এখন আদালতও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদী রক্ষার আদেশ দিয়েছেন। তারপরও তাঁরা নতুন করে অবৈধ বাজারে স্থাপনা করে যাচ্ছেন। কর্ণফুলী রক্ষা হলে নগরের ভারসাম্য ফিরে আসবে বলে আমি মনে করি।
আরএস