চৌগাছায় পশু হাট ইজারা আদালতের নির্দেশনা পালনে চলছে খাস আদায়

এম এ মান্নান, চৌগাছা (যশোর) প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০২৫, ০৮:০৮ পিএম
চৌগাছায় পশু হাট ইজারা আদালতের নির্দেশনা পালনে চলছে খাস আদায়

যশোরের চৌগাছা পশু হাট ইজারা নিয়ে চলছে রশিটানাটানি। দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেন্ডার ছাড়াই উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা এনে ইজারা নিতে চাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ উচ্চ আদালত হাট ইজারা ৮ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশনা পালনে চৌগাছা পৌর কর্তৃপক্ষ পহেলা বৈশাখ থেকে হাট খাশ কালেকশন করছেন।

সংশ্লিষ্ট নথিপত্র ঘেটে ও চৌগাছা পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, ১৪২৫ বাংলা সনের (ইংরেজি ২০১৮-১৯) পহেলা বৈশাখ চৌগাছা-মহেশপুর সড়কের ঋষিপাড়ায় বর্তমান পশু হাটটি স্থানান্তরিত হয়। সে বছর চৌগাছা পৌরসভা হাটটি খাশ আদায় করে। সে বছর পৌরসভা কর্তৃপক্ষ হাটটি থেকে ২৯,৫৪, ৫০০টাকা খাস রাজস্ব আদায় করেন। পরের বছর ১৪২৬ বাংলা সনে আদালতের নির্দেশনায় টেন্ডার ছাড়াই ৫০ লাখ ১ হাজার টাকায় হাটটি একসনা ইজারা পান ঝিানাইদহের আবিদুর রহমান। ১৪২৭ বাংলা সন থেকে ১৪৩০ সন পর্যন্ত ৪ বছর হাটটি আবারও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ খাস রাজস্ব আদায় করেন। এরপর ১৪৩১ সনে উচ্চ আদালতের (হাইকোর্ট) নির্দেশনা মোতাবেক আবারও ৫৪ লাখ ১ হাজার ৮০টাকায় ঝিনাইদহের আবিদুর রহমান হাটটি একসনা ইজারা পান। তবে এরমাঝে ১৪২৭ বাংলা সনে চৌগাছা পৌরকর্তৃপক্ষ পশু হাটটি থেকে ২৬ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, ১৪২৮ সনে ৩৭ লাখ ৯৩ হাজার, ৯৫০টাকা, ১৪২৯ সনে ২৫ লাখ ১৬ হাজার ৮৫০টাকা এবং ১৪২৯ সনে ২২ লাখ ৫১ হাজার ৮৫০টাকা খাস আদায় করেন। তবে পৌর কর্তৃপক্ষ এই ৫ বছর পশু হাটের খাস রাজস্ব আদায় করলেও পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে খাস আদায় কার্যক্রম না চালিয়ে হাট পরিচালনায় অভিজ্ঞ আবিদুর রহমানের লোকজন দিয়ে হাটের রাজস্ব আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করেন তৎকালীন পৌর মেয়র।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকার সব পৌর মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করে পৌরসভায় প্রশাসক নিয়োগ দেয়। চৌগাছা পৌরসভার প্রশাসক নিয়োগ পান সহকারী কমিশনার গুঞ্জন বিশ্বাস। কিছুদিন পর তার বদলি হয়ে যায়। চৌগাছায় সহকারী কমিশনার হিসেবে পদায়ন পান প্রকৌশলী তাসমিন জাহান। একইসাথে তাকে পৌর প্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকার।

পৌর প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েই পৌরসভার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে সক্রিয় হন প্রশাসন ক্যাডারের এই নারী কর্মকর্তা। সে হিসেবে ১৪৩২ বাংলা সনে চৌগাছা পৌরসভার সাধারণ হাট ও পশু হাট প্রকাশ্য টেন্ডারের প্রক্রিয়া শুরু করেন তিনি।

তবে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরুর পরই চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি ১৪৩১ সালে পশু হাটের ইজারাদার আবিদুর রহমান চৌগাছা পৌর প্রশাসক বরাবর একটি আবেদন করেন আগের বছরগুলোতে যে গড় রাজস্ব আদায় হয়েছে তার উপর ১০শতাংশ বৃদ্ধি করে ১৪৩২ সনে পশু হাট ইজারা পাওয়ার জন্য। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন ১৪২৬ বাংলা সনে তিনি ৫০ লাখ ১ হাজার টাকায় পশুহাট একসনা ইজারা নেন তখন করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে তিনি ২মাস ১৫দিন হাট পরিচালনা করতে পারেননি। আবার ১৪২৭ বাংলা সনে তিনি হাট ইজারা নিতে ৫৪ লাখ ১ হাজার টাকা পৌর কর্তৃপক্ষকে প্রদান করেন। তবে তিনি হাট ইজারা না পাওয়ায় পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে টাকা ফেরত চাইলে পৌর কর্তৃপক্ষ তাকে টাকা ফেরত দেয়নি। এতে তার আর্থিক ক্ষতি হয়। যা পুষিয়ে দিতে তৎকালীন পৌরমেয়র ১৪৩১ সনে তার টাকা সমন্বয়ের জন্য আবিদুর রহমানকে ১০ মাস ১৫দিনের জন্য পশুহাট ইজারা দেন। কথা ছিল ওই টাকায় ১২ মাস ইজারা আদায় করবেন। তবে আগস্ট-২০২৪ এবং এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তিনি ঠিকমতো হাট পরিচালনা করতে পারেন নি।

পৌরসভায় আবেদনের সাথে সাথে তিনি হাইকোর্টে একটি রিটপিটিশন (রিটপিটিশন নং-২২৫৫/২০২৫) দায়ের করেন যেন তিনি বিগত বছরগুলোর গড় আদায়ের উপর ১০শতাংশ বর্ধিত করে হাট ইজারা পেতে পারেন। যাতে তিনি বিবাদি করেন স্থানীয় সরকার সচিব, যশোরের জেলা প্রশাসক, চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং চৌগাছা পৌর প্রশাসক ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি)। রিট পিটিশনের আবেদনটি ১০ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে শুনানীর জন্য ১০০ নম্বরে ছিল। সেদিন শুনানি না হওয়ায় ৪৪ ডিএলআর (এডি) ২১৯- অনুসারে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইকবাল হোসেন একটি সার্টিফিকেট চৌগাছা পৌরসভায় জমা দেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি একই আবেদনটি একই আদালতে ১২৩ ক্রমিকে শুনানীর জন্য ধার্য্য ছিল। সেদিনও শুনানি না হওয়ায় আইনজীবী ইকবাল হোসেন ৪৪ ডিএলআর (এডি) ২১৯ অনুসারে আবারও সার্টিফিকেট পৌরসভায় জমা দেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি আবেদনটি হাইকোর্টের একই বেঞ্চে ৯৭নং ক্রমিকে শুনানীর জন্য দিন ধার্য্য হয়। সেদিন আদালত শুনানি গ্রহণ করেন এবং শুনানি শেষে মাননীয় আদালত চৌগাছা পৌর কর্তৃপক্ষের প্রতি রুল নিশি জারি করে আবেদনকারীর (আবিদুর রহমানের) পৌরসভায় করা আবেদনটি নিষ্পত্তি করার জন্য অর্থাৎ আবিদুর রহমানকে ইজারা দেয়ার জন্য পৌর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। যা আদালত থেকে লিখিত আদেশ পাওয়ার সাথে সাথেই পৌর কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে বলে আইনজীবী ইকবাল হোসেন ৪৪ডিএলআর (এডি) ২১৯ অনুসারে একটি সার্টিফিকেট চৌগাছা পৌরসভায় জমা দেন।

৩ মার্চ তারিখে আদালত রুলটির শুনানি মুলতবি থাকা অবস্থায় ৪নং বিবাদিকে অর্থাৎ পৌর প্রশাসক ও সহকারী কমিশনারকে আবিদুর রহমানের ১০শতাংশ বৃদ্ধি করে ইজারা পাইবার আবেদনটি নিষ্পত্তি করার জন্য লিখিত আদেশে স্বাক্ষর করেন। একইসাথে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করে আবেদনকারীকে ১৪৩২ সনের জন্য কেন চৌগাছা পশু হাট ইজারা দেয়া হবেনা এজন্য রুল জারি করার নির্দেশ দেন। এই আদেশ যেন বাদি পৌর প্রশাসককে রেজিস্ট্রার্ড ডাকযোগে এবং স্বাভাবিকভাবে জমা দেন তারও নির্দেশ প্রদান করেন আদালত।
আদালতের নির্দেশনা পেয়ে চৌগাছা পৌরকর্তৃপক্ষ ৫মার্চ পৌরসভার দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ইজারাদার আবিদুর রহমানকে পশুহাট ইজারা প্রদান করে পত্র প্রদান করেন। পত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক বিগত ৩বছরের গড় ইজারা মূল্যের চেয়ে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৬২ লাখ ২১ হাজার ২৪২ টাকা ইজারা মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এরসাথে ১০শতাংশ আয়কর এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করে ৭৭ লাখ ৬৪ হাজার ৫২টাকায় পশুহাটটি আবিদুর রহমানের অনুকূলে ইজারা দেয়া হয়। পত্রে ৭দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধ করে ৩০০টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তি করে সম্পাদন করে পৌরসভার কাছ থেকে হাট বুঝে নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়।

পত্র পেয়ে ৬ মার্চ ইজারাদার আবিদুর রহমান ইজারার টাকা পরিশোধ করে পৌরসভার প্রত্যয়নপত্র গ্রহণ করেন। পৌর কর্তৃপক্ষ ১১মার্চ ৩০০টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে আবিদুর রহমানের সাথে ইজারা সংক্রান্ত চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেন।

এদিকে ৬মার্চ’ই পশু হাট ইজারা নেয়ার জন্য চৌগাছার ঠিকাদার মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাকের আলিফ এন্টার প্রাইজ ৬২ লক্ষ টাকার উপর ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে, যশোর সদরের ঠিকাদার মশিয়ার রহমান ৬২ লক্ষ টাকার উপর ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করে এবং চৌগাছার ঠিকাদার আতিকুর রহমান লেন্টুর মেসার্স শয়ন ট্রেডার্স ৬২লক্ষ টাকার উপর ৩৮শতাংশ বৃদ্ধি করে চৌগাছা পৌর প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। অন্যদিকে ১৩মার্চ আবিদুর রহমান পক্ষের চৌগাছার দক্ষিণ কয়ারপাড়া গ্রামের গোবিন্দ কুমার রাহা ১৪৩১ সনের ৫৪ লাখ ১ হাজার ৮০টাকা ইজারার উপর ৬৩শতাংশ বৃদ্ধি করে এবং পাতিবিলা ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তদহ গ্রামের আতাউর রহমান লাল ১৪৩১ সালের ইজারার ৬৫শতাংশ বৃদ্ধি করে পশুহাট ইজারা পেতে আবেদন করেন।

এরই মধ্যে চৌগাছার ঠিকাদার আতিকুর রহমান লেন্টু সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালতে আবিদুর রহমানের ২২৫৫ নম্বর রিট পিটিশনের আবেদন নিষ্পত্তি করতে চৌগাছা পৌর প্রশাসককে দেয়া হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল (নম্বর-১০৭৮/২০২৫)দায়ের করেন। চেম্বার আদালত শুনানি শেষে গত ১৭ মার্চ আবিদুর রহমানের রিট পিটিশন-২২৫৫/২০২৫ হাইকোর্টের আদেশের উপর ৮ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেন। একই আদেশে আদালত ভ্যাকেশনের (ঈদের ছুটিসহ অন্য ছুটি) পর আদালত খোলার ৭দিনের মধ্যে হাইকোর্টের একটি কম্পিটেন্ট বেঞ্চে রুলটি নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা প্রদান করেন।

আদালতের স্থগিতাদেশ পেয়ে চৌগাছা পৌর কর্তৃপক্ষ ১৩ এপ্রিল ইজারাদার আবিদুর রহমানকে পত্রদিয়ে জানিয়ে দেয় উচ্চ আদালতের পরবর্তী আদেশের ভিত্তিতে চৌগাছা পৌরসভার পশু হাটের কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে এবং উচ্চ আদালতের আদেশ না আসা পর্যন্ত হাটের সকল রাজস্ব আদায় কার্যক্রম পৌরসভার তত্ত্বাবধানে অর্থাৎ খাস হিসেবে আদায় হবে।

এরপর ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ থেকে হাটটি খাস হিসেবে আদায় করছে চৌগাছা পৌর কর্তৃপক্ষ। পৌরসভার ১৩জন কর্মচারী এবং কাউন্সিলরের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারা এই আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

এ বিষয়ে চৌগাছা পৌর প্রশাসক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রকৌশলী তাসমিন জাহান বলেন, হাইকোর্টের আদেশে হাটটি আবিদুর রহমানকে ইজারা দেয়া হয়েছিলো। উচ্চ আদালত হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেছেন এবং ছুটির পর এক সপ্তাহের মধ্যে একটি কম্পিটেন্ট বেঞ্চে রুলটি নিস্পত্তির আদেশ দিয়েছেন। সে কারণে আবিদুর রহমানের অনুকূলে দেয়া ইজারাপত্র স্থগিত করে হাটের সকল আদায় পৌরসভার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তিনি জানান, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী হাটের পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

ইএইচ