- খেলাপি বিবেচণায় শিল্প ঋণে নিরুৎসাহ
- বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শ বাস্তবায়নের উদ্যোগ
চলমান অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে এবং আসন্ন দুর্ভিক্ষের হুমকি মোকাবিলায় কৃষি ঋণে গতি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন গভর্নর। সরকারের কৃষি নীতির পূর্ণ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ডেকে এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে উচ্চ খেলাপি বিবেচনায় শিল্প ঋণে বিনিয়োগ কমানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) বিকাল তিনটায় বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গির আলম কনফারেন্স হলে বেসরকারি ব্যাংকসমুহের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সাথে বৈঠকে বসেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা এতে অংশ নেয়।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, খাদ্যপণ্যে আমদানি নির্ভরতা কমাতে সরকারপ্রধানের কৃষিতে জোড় দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে এমডিদের। এর অংশ হিসেবে দেশে যেসব খাদ্য উৎপন্ন হচ্ছে সেসব পণ্য যাতে বিদেশ থেকে আমদানি করতে না হয় সে লক্ষ্যে টার্গেট ভিত্তিক কৃষি ঋণ বৃদ্ধি করতে জোড় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। চলামান কৃষি স্কিমগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়নের পাশাপাশি স্বাভাবিক লোনের ক্ষেত্রে কৃষির ওপর বিশেষ দৃষ্টি বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। যেসব ব্যাংক কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে তাদেরকে সাধুবাদ জানিয়েছেন গভর্নর। সংকট মোকাবিলায় নতুন পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি যেসব ব্যাংক কৃষি ঋণের প্রতি উদাসীনতা দেখাচ্ছে তাদের কড়া বার্তা দেয়া হয়েছে।
বৈঠক শেষে আমার সংবাদের সাথে কথা বলেন, অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হুসাইন। তিনি বলেন, ‘নতুন কোন বিষয়ে আলোচনা হয়নি। তবে কৃষি ঋণে গতি বাড়াতে বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে। কারণ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আইএমএফসহ সকলেই কৃষি ঋণের উপর গুরুত্বারোপ করার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ প্রান্তিক পর্যায়ের ঋণে ক্ষতির পরিমাণও অনেক কম। এটি তুলণামূলক ঝুঁকিমুক্ত। এ ঋণে সাধারণত খেলাপি হয় না। খেলাপি হয় বড় ঋণে।’ তিনি বলেন, ব্রাক ব্যাংক আগে থেকেই কৃষিঋণে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হবে।
এর আগে কোন কৃষি জমি অনাবাদি না রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই টাকার অভাবে যাতে কোন কৃষকের ফসল ফলাতে বেগ পেতে না হয় সেটি নিশ্চিত করতে চায় বাংলাশে ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত ছোট ঋণে আগ্রহ দেখায় না বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এতে তাদের বেশি জনক্তি নিয়োগ করতে হয়। ফলে অল্প ঋণে বেশি খরচ হয় । তাই স্বাভাবিকভাবেই কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া বাকিরা কৃষি ঋণ বিতরণে পিছিয়ে থাকে। বিষয়টি আমলে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক করোনাকাল থেকেই কৃষি ঋণে জোড় দিয়ে আসছে। এখন আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখভাল করছে কেন্দ্রিয় ব্যাংকের কৃষি ঋণ বিভাগ।
এর আগে ৩১ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে চলতি অর্থবছরের কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক; যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ বেশি। মহামারীর মধ্যে যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের পণ্য বাজারে অস্থিরতার মধ্যে যখন সরকার খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছে, দৃশ্যত তা অনুসরণ করেই কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্য মাত্রা বাড়ানো হয়েছে।
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে। কৃষিতে ৪ ও ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদে ঋণ দেওয়া হয়। সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদের কৃষি ঋণ বিতরণের সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় শুধু কৃষি উৎপাদনে সম্পৃক্ত কৃষকদের জন্য। তবে এখন সেই ঋণ কর্পোরেট কোম্পানিতেও যাচ্ছে, যারা কৃষি ঋণ নিয়ে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’ করছেন। এতে কৃষি খাতে অসম প্রতিযোগিতা ফুটে উঠেছে। বড় কোম্পানিগুলোর বড় অঙ্কের বিনিয়োগ চাপের বিপরীতে প্রান্তিক কৃষক কৃষি পণ্যর উৎপাদন খরচ ও বিপণনে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
ফসল ও সবজি চাষে চলতি অর্থবছরে ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এরমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে ১১ হাজার ৭৫৮ কোটি এবং বেসরকারি ব্যাংক ১৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা বিতরণ করবে। গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয় ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ২৮ হাজার ৩৯১ কোটি টাকার চেয়ে বেশি। গত অর্থবছরের বিতরণকৃত ঋণের ৩৩ লাখ ৪ হাজার ৮১১ জন কৃষি ও পল্লী ঋণের সুবিধা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৭ লাখ ৯৭ হাজার নারী নিয়েছেন ১০ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। আর চর, হাওরসহ অনগ্রসর এলাকায় কৃষি ঋণ বিতরণ হয়েছে ১৯ কোটি টাকা।
ইএফ