গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেকটায় স্বস্তি নেমে এসেছিলো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যে। তবে সে স্বস্তি অস্বস্তি হতে সময় লাগেনি বেশি। দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে আবারও ঊর্ধ্বমুখী হয় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। বেয়াড়া হয়ে ওঠা সে বাজারকে নানা কসরতেও বাগে আনতে পারছে না সরকার।
দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক বৃদ্ধির পিছনে নানা রকম হাতবদলকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। বাস্তবেও পাওয়া যায় তার সত্যতা। উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পণ্য হাতে পৌঁছাতে পার করতে হয় বেশ কয়েকটি ধাপ। এর মধ্যে প্রথমেই উৎপাদনকারী থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ী, ব্যাপারী, ফড়িয়া, পাইকারি বাজার ও খুচরা বাজার হয়ে পণ্য পৌঁছায় ভোক্তার হাতে। এতে করে প্রতিটি ধাপে লাভ ও খরচ মিলিয়ে উৎপাদনকারী হতে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় কয়েকগুণ বেড়ে যায় পণ্যের দাম।
সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে গবেষণা পরিচালনা করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। তাদের গবেষণায় দক্ষ বাজার ব্যবস্থা পণ্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি।
এছাড়াও পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, বাজার আধিপত্য প্রভৃতি কারণে স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। কৃত্রিম সংকট, ঋণপত্র খোলায় বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা, টাকার মূল্যমান হ্রাস, সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থায় অদক্ষতা প্রভৃতি বিষয় পণ্যমূল্য ওঠানামায় ভূমিকা রাখছে বলে জানায় সংস্থাটি।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের এমন বেয়াড়া হয়ে ওঠার পরও অভিযোগ আছে কৃষক ন্যায্যমূল্য না পাবার। কৃষক ও ভোক্তার মাঝে দামের এমন পার্থক্যের কারণ অনুসন্ধানে গিয়ে পাওয়া গেছে চোখ কপালে ওঠার মত তথ্য। কারওয়ান বাজার পাইকারি মোকাম থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসতে আসতে বেড়ে যাচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত দাম। আরেকটু দূরে মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারে এসে তা হয়ে যাচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি।
সরেজমিনে শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার ও শেওড়াপাড়া বাজার ঘুরে পাওয়া গেছে এমনই চিত্র। এসময় একটি লাউয়ের দাম কারওয়ান বাজারে পাইকারি মূল্যে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেলেও এর থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে রাস্তায় সে একই লাউ ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। আবার এটি টাউন হল ও শেওড়াপাড়া বাজারে এসে ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়।
শুধু লাউ নয়, প্রায় প্রতিটি পণ্যেই দেখা গেছে মূল্যবৃদ্ধির একই রকম চিত্র। এদিন কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি ঢেড়স ৪৫-৫০ টাকা, করলা ৭০ টাকা, লম্বা বেগুন ৮০-৯০ টাকা বিক্রি হলেও কারওয়ান বাজার খুচরা মূল্যে যথাক্রমে ঢেড়স ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, লম্বা বেগুন ৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা যায়। একই পণ্য টাউন হল বাজারে যথাক্রমে ১২০, ১২০ ও ১৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা যায়।
এছাড়াও বড় পার্থক্য দেখা যায় আদার দামে। কারওয়ান বাজারে পাইকারি দোকানে প্রতি কেজি আদা ২০০-২৫০ টাকা, খুচরায় ২২০-২৭০ টাকা ও মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারে ৩০০-৩৬০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। আলু, পেয়াজ ও রসুনের দামেও ছিলো বড় পার্থক্য। প্রতিটি পণ্যের মূল্যেই ১০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত ব্যবধানে বিক্রি হতে দেখা যায়।
গত ১৭ অক্টোবর কারওয়ান বাজারে ন্যায্যমূল্যে অত্যাবশকীয় কৃষিজাত দ্রব্যাদি বিক্রয় কার্যক্রমের উদ্বোধনে গিয়ে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, এসব সিন্ডিকেট প্রতিদিন ‘নতুন নতুন পদ্ধতি’ আবিষ্কার করে। সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য এই সরকারের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। শুধু তথ্য উপাত্ত আর আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন।
তবে এমন হুশিয়ারিতেও বাগে আসছে না দ্রব্য মূল্য। বরং পকেট ভর্তি টাকা নিয়েও বাজারের ব্যাগ অর্ধেক খালি রেখেই ফিরতে হচ্ছে বাসায়। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই সবজি রান্নায় অনেকটা কৃচ্ছতা সাধণ করছেন গৃহিণীরা। সেই সঙ্গে কমেছে জনপ্রতি ক্যালোরি গ্রহণের মাত্রাও।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কনজিউমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এটা কমাতে হলে আমাদের আইনের প্রয়োগ গঠাতে হবে। আমরা যদি আইনের প্রয়োগ যথাযথভাবে ঘটাতে পারি তাহলেই দ্রব্যমূল্যের দাম কমে আসবে। আরেকটা জিনিস করতে হবে, সেটা হচ্ছে হাত বদল বন্ধ করতে হবে। হাত বদল যত কম হবে পণ্যের দামও ততো কম হবে।
দ্রব্যমূল্য সিন্ডিকেটমুক্ত করতে সরকারের বিকল্প ব্যবস্থা করা উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারে উচিত বিকল্প ব্যবস্থাটা আরও শক্তিশালী করা। এখন ট্রাকে করে সবজি যেটা বিক্রি করছে সেটার পরিমাণও বৃদ্ধি করা উচিত। এছাড়াও কৃষক যেনো সরাসরি বাজারে এনে ভোক্তার কাছে তার পণ্যটা দিতে পারে সে ব্যবস্থাও সরকারকে করতে হবে।
সরকারের প্রায়োরিটি লিস্টে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নেই উল্লেখ করে এস এম নাজের হোসাইন বলেন, সরকার অনেক কিছু নিয়ে ব্যস্ত। সেগুলোও করতে হবে তবে সবার আগে সরকারের উচিত ছিলো এই দিকে নজর দেয়া। যদি সরকার এই দিকে নজর দিতো তাহলে সেটা আরও দ্রুত সরকার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারতো। আমরাও সেটা দেখতে পারতাম।
বিআরইউ