অর্থ উপদেষ্টা

টাকার জোগান দিতেই ভ্যাট বাড়িয়েছি

আমার সংবাদ ডেস্ক প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৫, ০৮:১৭ পিএম
টাকার জোগান দিতেই ভ্যাট বাড়িয়েছি

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমরা ক্ষুরের ওপর দিয়ে হাঁটছি। চেষ্টা করছি, বলবো না যে, আমরা খুব ভালো করছি। অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমরা খারাপ নেই। আমরা মোটামুটি ভালো আছি।

বাজেটের মাধ্যমে ভ্যাট না বাড়িয়ে বছরের শুরুতে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা গুরুতর আহত তাদের প্রত্যেককে ৩৫ লাখ টাকা করে কয়েকশ কোটি টাকা দিতে হয়েছে। পুলিশের ৩০০ গাড়ি পুড়িয়েছে, সেখানে ৫০০ কোটি টাকা দিতে হবে। এই টাকা আমি কোথা থেকে পাবো। টাকার জোগান দিতেই ভ্যাট বাড়িয়েছি।

রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। বিএসআরএফের সাধারণ সম্পাদক মাসউদুল হক মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন। সভাপতিত্বে করেন সংগঠনের সভাপতি ফসিহ উদ্দীন মাহতাব।

বছরের শুরুতে ভ্যাট বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমাকে অনেক টাকা দিতে হয়েছে। এ টাকা আমি কোথা থেকে দেবো। তাই ভ্যাট বাড়িয়েছি। তারপর অনেকগুলোতে কমিয়েও দিয়েছি।

তিনি বলেন, আমার রিসোর্স গ্যাপ অনেক বেশি। এজন্য আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবির সহায়তা নিতে হয়েছে। আমাদের ঋণ শোধ করতে হয়, কোনোদিন খেলাপি হয়নি। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা আমাদের সাহায্য করছে। 

তিনি আরও বলেন, আমরা ক্ষুরের ওপর দিয়ে হাঁটছি। চেষ্টা করছি, বলবো না যে, আমরা খুব ভালো করছি। অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমরা খারাপ নেই। আমরা মোটামুটি ভালো আছি। অবশ্যই আমরা একটা কল্যাণমুখী, সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র করার চেষ্টা করছি। তবে সেটা অনেক দূরে, সেটা পলিটিক্যাল সরকার করবে।

অন্য এক প্রশ্নে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক থেকে অর্থ আনতে অর্থনীতির কতগুলো শর্ত মানতে হবে। আমরা কখনো শর্তে ফেল করিনি। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে অনেক আলোচনা হয়েছে৷ তারা বলেন, ‘ভ্যাট বাড়াও’, ভ্যাট বাড়িয়ে এখন নানান রকম বিপত্তি হয়েছে। এগুলো খুব সেনসিটিভ, এক-দুই টাকা বাড়ানো মানে প্রবাসীদের জন্য নয়, আমাদের এখানে আমদানিকারক আছেন, নানা রকম অবলিগেশন আছে, যা কিছু আমদানি করছে সেগুলোর দাম বেড়ে যাবে।

তিনি বলেন, জনগণের এখতিয়ার মানে রাজনৈতিক সাপোর্ট, আমরা কিন্তু ক্ষমতায় আসিনি, আমাদের দেওয়া হয়েছে। আমরা যেটা করছি কিছু কিছু কারণ আছে, সবকিছু ভেবেচিন্তে করছি। এখানে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা আছে, রাজনৈতিক ব্যাপার আছে। তাহলে কীভাবে আমরা রাজস্ব ব্যয় কমাবো। এক্ষেত্রে আমি পজেটিভ। 

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের প্রবাসীরা ব্যবসা করতে চান না। তবে ব্যবসা করা কঠিন। সব কিছু তো আমরা করে দেবো না। সরকারের আয়-ব্যয়ে ব্যালেন্স করতে হয়। সেটা সবসময় যুক্তিসঙ্গত হবে তা কিন্তু নয়। ট্যাক্সের ক্ষেত্রে আপনি দেবেন, লাভবান আপনি হবেন। আমরা চাই একেবারেই সাধারণ মানুষ যেন লাভবান হয়। এখন শিক্ষকদের অনেক ডিমান্ড আছে, সেটা আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখবো। 

তিনি বলেন, প্রতিদিন যে তারা রাস্তাঘাট আটকে রাখে, এটা সত্য যে আমরা অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক সরকারের মতো শক্তিশালী না। এখন যদি মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তখন দোকানদাররা দোষ দেওয়া শুরু করে। এটা সত্য আমরা অনেক চাপের মধ্যে আছি। ১০০টা চাপের মধ্যে আমরা ১০টা মানি। এই যেমন রেলওয়ের ডিমান্ড—ওভারটাইম দাও, দিলাম। এরপর বলে লিমিট উঠিয়ে দাও, সেটাও উঠিয়ে দিলাম। কয়েকদিন পর বলবে, চাকরি থাকবে না বেতন দাও? তখন আমি কী করবো? সেটা নিয়ে চিন্তায় আছি। 

ভ্যাট বাড়ানোর পর চপ্পলের দাম বেড়েছে, সেটা নিয়ে কিছু মেয়ে প্রতিবাদ করেছেন। সে বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সস্তা চপ্পলে যদি ভ্যাট থাকে সেটা আমি রিভিউ করবো। যেমন ২০০ টাকা দামের ওপরে বিস্কুটে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এইচএস কোড থাকে, সেখানে অনেকগুলো পণ্য থাকে। সেখানে যদি চপ্পল থাকে তাহলে একটু সমস্যা।

তিনি বলেন, এডিবি ডিসেম্বরে ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেবে, জুনে বিশ্বব্যাংক ৫০০ মিলিয়ন দেবে এবং আইএমএফ মার্চে না হয় জুনে ২ বিলিয়ন ডলার দেবে। তাদের কতগুলো শর্ত আছে। যেমন- ট্যাক্স, ভ্যাট বাড়ানোর। সেখানে আমি যৌক্তিকভাবে দেখলাম যে আয়কর বাড়ালে সংসদে যেতে হবে৷ আর যদি ভ্যাট ট্যাক্স বাড়াই তাহলে একটি এসআরও দিয়ে আমি করতে পারবো। এখানে কিন্তু বেশি টাকা নয়। মাত্র ১২ হাজার কোটি টাকা। একে কিছু প্রভাব পড়েছে সেটা ঠিক।

এর আগে বক্তব্যের শুরুতে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ভ্যাট বাড়িয়েছি, সেটা নিয়ে বহু কথাবার্তা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কিছু কিছু ভুল তো হয়। কিছু কিছু আড়ালে চলে যায়। তখন আপনারা বলেন, আমরা চেষ্টা করি সেটা করার জন্য। 

তিনি বলেন, একটা জিনিস মনে রাখবেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ সবসময় পপুলার ডিমান্ডে করা যায় না। এটা আপনারা লক্ষ্য করেছেন। আমাকে এখন অনেক অর্থনীতিবিদ বলছেন- সব ট্যাক্স কমিয়ে দেন, ভ্যাট কমিয়ে দেন। রাজস্ব বাড়ান। অনেকে বলেন- আমরা এতোগুলো কথা বললাম, এই অর্থ উপদেষ্টা কিছুই তো বাস্তবায়ন করছে না। বাস্তবায়ন যে হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়।

তিনি আরও বলেন, মানুষের মধ্যে এখন আস্থা আসছে। বিদেশ থেকে অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে না পাঠিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাচ্ছে। সবই ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে তা বলবো না। হুন্ডির মাধ্যমে এলে সব টাকা দেশে আসে না। কারণ, ওটা বাইরেই থেকে যায়। বহু মানুষ আছে ডলার রেখে দেয়, আপনার টাকা পাঠায়। একটা ম্যাসেজ দিলো, হুন্ডা নিয়ে চট করে টাকা দিয়ে চলে যায়। কিন্তু আসার কথা ডলার। সেটা না আসার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রভাব পড়ে। 

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, কিছুদিন আগে আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ ছিল। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ ছিল। আমাদের রপ্তানি গ্রোথও নেগেটিভ ছিল। এখন কারেন্ট অ্যাকাউন্ট, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট পজেটিভ। মোটামুটি ম্যাক্রো ইকোনমিক স্টেবিলিটি আছে। একেবারে পুরোপুরি চলে আসছে সেটা বলবো না। 

বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর কোন দেশে চার-পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে বিদেশে যায়? নেপাল, ইন্দোনেশিয়া বা ভারতের কেউ এত টাকা দিয়ে বিদেশ যায় না। এত বেশি টাকা লাগার মূল কারণ যারা এজেন্ট তারা বেশিরভাগ টাকা নিয়ে নেয়। ভাড়ার টাকা এত বেশি হওয়ার কথা না। বিদেশে যেখানে পাঠায় সেখানেও টাকার ভাগিদার আছে।

তিনি আরও বলেন, বেতন-ভাতা যা পায় তা কিন্তু আশানুরূপ না। এর মূল কারণ হলো বেশিরভাগ অদক্ষ। আমি কয়েকদিন আগে মদিনা থেকে এলাম। দু-একটা হোটেলের ম্যানেজার বাঙালি, বেশিরভাগ ক্লিনার। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কান, ভারতীয় বা পাকিস্তানিদের বেশিরভাগ ম্যানেজার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার অথবা ডেস্কে বসে। তফাতটা হলো তারা মোটামুটি লেখাপড়া জানা এবং ভাষাটাও ভালো জানে। আমাদের এখন দক্ষ জনবল বিদেশে পাঠানোর সময় এসেছে। 

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা চেষ্টা করছি, ব্যর্থতাও আছে। আমরা কন্টিনিউ করতে পারবো না, সব সংস্কার করতে পারবো না। আমরা একটা ফুটপ্রিন্ট রেখে যেতে চাই। ফুটপ্রিন্ট মানে আমরা যেটা করছি, লোকজন কনভিন্স, যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা যেন এটা কন্টিনিউ করেন। যারা আসবেন তাদের রেসপনসিভ হতে হবে।

তিনি বলেন, ভ্যাটের ব্যাপারে চাপ আছে। ভ্যাট কমাতে বলা হয়। সব ভ্যাট যদি কমিয়ে দেন সরকারের আয় কোথায়? আমরা ধার করছি। আবার বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বলছে- কোনোভাবেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ কমাবেন না।

আরএস