অসামঞ্জস্যপূর্ণ নকশা প্রণয়নের ফলে বন্ধ হয়ে গেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আ ফ ম কামালউদ্দিন হল ও শহীদ সালাম-বরকত হল সংলগ্ন মসজিদের নির্মাণ কাজ। এই দুই হলে প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী বসবাস করেন। মসজিদটিতে প্রতি শুক্রবার প্রায় ১২০০ জন মুসল্লি জুমার নামাজ আদায় করেন, তবে নির্মিতব্য মসজিদের ধারণক্ষমতা মাত্র ৫৩৪ জনের।
চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে নতুন করে নির্মাণের উদ্দেশ্যে মসজিদটি ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয়। দুই মাস কাজ বন্ধ থাকার পর শহীদ সালাম-বরকত হলে নতুন প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ হলে জুন মাসে পুনরায় কাজ শুরু করে ভেঙে ফেলা হয় মসজিদটি।
বর্তমানে অস্থায়ী ছাউনির নিচে নামাজ আদায় করছে শিক্ষার্থীরা। যেখানে তাদের নানবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর টয়লেট, অজুর জায়গার সংকীর্ণতাসহ ছাউনির চারপাশ খোলা হওয়ায় মশার কামড় ও বৃষ্টি থেকেও রেহাই মিলছে না। নির্মাণ কাজের ফলে মসজিদে আজান বন্ধ থাকায় প্রায়ই নামাজের সময় নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
নতুন মসজিদ নির্মাণের কথা মাথায় রেখে শিক্ষার্থীরা এসকল সমস্যা মেনে নিচ্ছেন বলে জানান মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম জাহান।
তিনি বলেন, আমাদের বলা হয়েছিল ৭৫০ জনের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন মসজিদ নির্মাণ করা হবে, সেখানে এখন শুনছি ধারণক্ষমতা মাত্র ৫৩৪ জন। তার উপর পর্যাপ্ত অযুর ব্যবস্থা নেই, একটা মাত্র টয়লেট, এভাবে তো হয় না। এতো সমস্যা হওয়া সত্বেও আমরা মানিয়ে নিচ্ছি ভাল একটা মসজিদ হবে এই আশায়। আমাদের দাবি হচ্ছে মসজিদ যেন বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে নির্মাণ করা হয়।
জানা যায়, দুই হলের সংস্কার বাবদ প্রাপ্ত অর্থ থেকে নতুন মসজিদ নির্মাণের জন্য মোট ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মসজিদ নির্মাণের কাজ চলছে হল সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজে কলমে নতুন মসজিদ নির্মাণের উল্লেখ নেই, নেই মসজিদের কাজের জন্য আলাদা কোন বরাদ্দ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, দুই হলের প্রভোস্ট হলের সংস্কার কাজ স্যাক্রিফাইস করে মসজিদের জন্য টাকা দিবে, দিস ইজ দা সলিউশন।
নির্মিতব্য মসজিদের ধারণ ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে পূর্বে ৭৫০ জন বলা হলেও কাজ শুরু করতে গিয়ে দেখা যায় নকশায় মসজিদের ধারণক্ষমতা ৫৩৪ জন উল্লেখ করা হয়েছে এবং মসজিদের বিস্তারিত নকশাও কনসালট্যান্ট ফার্ম সরবরাহ করেনি। শহীদ সালাম-বরকত হল অফিস থেকে কনসালট্যান্ট ফার্ম ‘অ্যাকুমেন’ কে একাধিকবার বলার পর তারা আগস্ট মাসের শুরুর দিকে ব্যাকডেটে বিস্তারিত নকশা প্রদান করে। মসজিদে নামাজ আদায়কারী নিয়মিত শিক্ষার্থীরা মসজিদের ধারণক্ষমতা ৫৩৪ জন জানতে পেরে উভয় হল কর্তৃপক্ষের নিকট আপত্তি তোলেন এবং ১০ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। এর প্রেক্ষিতে বন্ধ রয়েছে মসজিদ নির্মাণের কাজ।
এ বিষয়ে শহীদ সালাম বরকত হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আলী আজম তালুকদারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি যে কাগজে সাইন করেছিলাম সেখানে ধারণক্ষমতা ৭৫০ জনই লেখা ছিল, আমি যেটা জানতাম সেটাই সবাইকে বলেছি।
তবে পরবর্তীতে শহীদ সালাম বরকত হলের অফিসে গিয়ে মসজিদ নির্মাণ সংক্রান্ত নথি যাচাই করে দেখা যায় অধ্যাপক আলী আজম তালুকদার গত বছরের ১০ এপ্রিল ৫৩৪ জন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন মসজিদের নকশায় (ফ্লোর প্ল্যান) স্বাক্ষর করে গেছেন।
এ বিষয়ে পরবর্তীতে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটাতো হতেই পারে না। আমি ৫০০-৬০০ জনের কোন নকশায় সাইন করি নাই, এটা হতেই পারে না।
এছাড়াও মসজিদের নকশায় টয়লেট রাখা হয়েছে মাত্র একটি এবং অযুখানায় একসাথে মাত্র আটজনের অজু করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
কনসালট্যান্সি ফার্মের বরাত দিয়ে শহীদ সালাম বরকত হল অফিস থেকে জানানো হয়, বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী বড় করে মসজিদ নির্মাণ সম্ভব নয়, বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে যেভাবে মসজিদ নির্মাণ সম্ভব সেভাবেই নকশা করা হয়েছে। শিক্ষার্থী এবং অন্যান্য অংশিজনেরা ৫৩৪ জন ধারণক্ষমতার মসজিদ নির্মাণকে অদূরদর্শী এবং টাকার অপচয় বলছেন। এর ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে নির্মাণ কাজ।
শহীদ সালাম বরকত হলের বর্তমান প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সুকল্যান কুমার কুন্ডু বলেন, মসজিদ নির্মাণ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দুইতলা বিশিষ্ট মসজিদে পর্যাপ্ত ধারণক্ষমতা না থাকায় আমরা বড় করে একতলা নির্মাণের চিন্তা ভাবনা করছি। যেখানে পরবর্তীতে দুইতলা বা বেশি করার মত ভিত্তি স্থাপন করা হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে নতুন করে নকশা প্রণয়ণ করে সেটার অনুমোদন নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। আশা করি আমরা অচিরেই এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবো।
আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের প্রাধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, ইনিশিয়ালি আমাদের ধারণক্ষমতা বেশি জানানো হয়েছিল, পরে জানলাম ধারণক্ষমতা অনেক কম। আমাদের হয়তো ভুল জানানো হয়েছিল। যেহেতু মসজিদের দায়িত্ব এখন সালাম বরকত হলে রয়েছে, আমি ছাত্রদের দাবি মাথায় রেখে আমাদের বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে কিভাবে এটার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায় সেটা নিয়ে সালাম বরকত হলের প্রভোস্টের সাথে আলোচনা করবো।
সার্বিকভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়া মসজিদের কাজের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ নূরুল আলম বলেন, মসজিদের বিষয়ে অফিসিয়ালি আমাকে কিছু জানানো হয়নি। এমনিতেই এবার আমাদের বাজেট ঘাটতি, এর মধ্যে কোথা থেকে ভর্তুকি দিবো?
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ একটি সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য নিয়োগ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মসজিদ নির্মাণ সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না।
কেএস