চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট দীর্ঘদিনের। সংকট সমাধানে চবি প্রশাসন অতীশ দীপঙ্কর হলের নির্মাণের কাজ করে। ৫ হাজার ৪৭৮ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে সর্বমোট ১৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এই হলের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয় ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি।
হলটির দ্বিতীয় ধাপের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। তবে দফায় দফায় সময় বাড়লেও কাজ শেষ হয়নি নির্ধারিত সময়ে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি বাতিলের পর অবহেলা, অযত্নে নির্বাক দাড়িয়ে আছে হলটি। অথচ ২০২০ সালের জুলাই থেকে এই হলে নিয়োগ পেয়েছেন তিনজন প্রভোস্ট।
না হলের নির্মাণ কাজ শেষ হলো; না শিক্ষার্থীদের আসন বরাদ্দ দেওয়া হলো! দীর্ঘসময় নির্মাণ কাজ আটকে থাকায় হলটিতে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার সম্পদ। প্রভোস্ট নিয়োগের মধ্যেই চলতি বছরের জুলাই মাসে হল থেকে আনুমানিক ২০ লাখ টাকার সরঞ্জামাদি চুরির অভিযোগ উঠেছে। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে টনক নড়ে চবি প্রশাসনের।
চুরির বিষয়টি আমলে নিয়ে সহকারী প্রক্টর ড. শহিদুল ইসলামকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কোনো প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি কমিটি।
তবে জানা গেছে চুরি যাওয়া জিনিসের মধ্যে আছে প্রায় ৩০টি থাই অ্যালুমিনিয়াম ও জানালার কপাট, ২০টি দরজার লক, প্রায় ২৫টি বৈদ্যুতিক বোর্ড, ৩০টি বাতি, ৭টি গ্যাসের চুলা, ৩টি গ্যাস লাইজার ও ১টি পানির মোটরসহ আরও অনেক সরঞ্জাম। তাছাড়া দেয়ালের পাইলিং ভেঙে বৈদ্যুতিক তার কেটে নেওয়াসহ দরজার তালা ভেঙে প্রভোস্ট কক্ষে থাকা টেবিলের কাচও নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
হলটি উদ্বোধনের দু`বছর পর ২০১৮ সালে হলের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজের দায়িত্ব নেন আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলম চৌধুরীর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মঞ্জুরুল আলম এন্ড কোং।
৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের কাজ সাড়ে ৬ মাসের মধ্যে শতভাগ শেষ করতে বলা হলেও নির্মাণ কাজ চলেছে কচ্ছপ গতিতে। গত ৫ বছরের চেয়ে বেশি সময় নিয়ে এই প্রকল্পের কাজ মাত্র ৭০ শতাংশ শেষ করতে পেরেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় নির্মাণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এরপর থেকেই হলটি অযত্নে, অবহেলায় পড়ে ছিল। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না করায় হলটি মাদকসেবী ও জুয়ারিদের সরাইখানায় পরিণত হয়। ধীরে ধীরে চুরি হতে থাকে হলের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি। প্রায় ২০ লাখ টাকার সরঞ্জামাদি চুরি হয়।
এসবের মধ্যেই হলের দায়িত্বে আসে পরপর তিনজন প্রভোস্ট। অসম্পন্ন নির্মাণ কাজের মধ্যেই তারা নিয়োগ পেয়েছেন। ২০২০ সালের ৩০ জুন ১ বছরের জন্য এই হলের প্রথম প্রভোস্ট হিসেবে নিয়োগ পান বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম।
পরের বছর ২০২১ সালের ১লা জুলাই হলের দ্বিতীয় প্রভোস্ট হিসেবে যোগদান করেন নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. কুন্তল বড়ুয়া। সর্বশেষ গত ২রা আগস্ট প্রভোস্টের দায়িত্ব পান ফলিত রসায়ন ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সুমন বড়ুয়া। প্রত্যেকেই হল প্রভোস্টের সকল সুবিধা ও ভাতা গ্রহণ করছেন বলে হিসাব নিয়ামক দফতর সূত্রে জানা গেছে।
কিন্তু হলটিতে চুরির বিষয়ে দায়ভার নিচ্ছে না নিরাপত্তা ও প্রকৌশল দপ্তরসহ হল কতৃপক্ষ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
হলটির বর্তমান প্রভোস্ট ড. সুমন বড়ুয়া বলেন, ‘আমি প্রভোস্ট হওয়ার আগে চুরির ঘটনা ঘটে। তবে এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওনারা তদন্ত করছেন। নির্মাণাধীন কাজের দায় প্রভোস্ট নিবে না। নির্মাণ সম্পর্কিত কোন কিছুই প্রভোস্টের হাতে নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) ছৈয়দ জাহাঙ্গীর ফজল বলেন, ‘হলের দায়িত্বে প্রভোস্ট আছেন। ওখানে আমাদের আর কিছু করার নেই। চুরির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এ বিষয়ে আমি আর কোন মন্তব্য করতে চাই না।’
তদন্ত কমিটির প্রধান ও সহকারী প্রক্টর ড. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অতীশ দীপঙ্কর হলে চুরির ঘটনায় এখনো তদন্ত চলছে। এটি বহুদিনে ঘটা একটি ঘটনা। তাই প্রতিবেদন জমা দিতে আমাদের সময় লাগছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান বলেন, ‘অতীশ দীপঙ্কর হলে চুরির বিষয়টি আমাদের অবগত আছে। এই নিয়ে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। চুরি প্রতিরোধে আমাদের সর্বোচ্চ সর্তকতা রয়েছে। আমরা যথাসম্ভব নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছি। তবে নতুন করে নিরাপত্তা কর্মী এখনও নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
অসম্পন্ন নির্মাণের মাঝেই প্রভোস্ট নিয়োগের বিষয়ে মনিরুল হাসান আরও বলেন, হলের নির্মাণ কাজসমূহ সুন্দর ও গুছিয়ে করার জন্যই প্রভোস্ট নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এআই