যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) এক শিক্ষার্থীকে হলে আটকে রেখে মারধর ও ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে।
রোববার (২ এপ্রিল) সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মসিয়ূর রহমান হলের ৫২৮ নম্বর কক্ষ থেকে অচেতন অবস্থায় ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়।
ভুক্তভোগী ইসমাইল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড টেকনোলজি (এনএফটি) বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর ভাষ্যমতে, সোহেল নামের এক শিক্ষার্থী ভুক্তভোগি শিক্ষার্থীকে ডেকে বলে সিনিয়র ভাইয়েরা ফোন দিলে রিসিভ করোনা কেন! ভাইদের সাথে দেখা কইরো। এরপর যোহরের নামাজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ থেকে ইসমাইলকে শহীদ মসিয়ূর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সালমান (সিএসই চতুর্থ বর্ষ) হলের ৫২৮ নং রুমে নিয়ে যায়।
রুমে ঢোকার পরে শোয়েব ও সালমাসহ নীল পাঞ্জাবি পরিহিত একজন, দুপুর ২ টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত ইসমাইলকে চড়,থাপ্পড়, বেল্ট,জিআই পাইপ ও স্টাম্প দিয়ে মারধর করে। পরে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীর বন্ধু ও ভাইয়েরা জানতে পেরে তাঁকে উদ্ধার করে। তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে যশোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জানান, রুমে ঢুকেই শোয়েব (সিএসই চতুর্থ বর্ষ) আমার নাম পরিচয় জানতে চেয়ে বলে তুই তো বড়ভাইদের সম্মান করতে জানিস না, এই তুই তো সিন্ডিকেট চালাস। এরপর আমাকে তাঁদের মাঝখানে বসিয়ে প্রথমে শোয়েব চড় মারে, আমি রোজা ছিলাম, মাথা ঘোরা শুরু হলো, চোখ মুখ অন্ধকার দিতে শুরু করে। সাথে সাথে অন্যপাশ থেকে সালমানও চড় মারে। তুই সিন্ডিকেট চালাস,স্বীকার কর, তোর সাথে আর কে কে আছে, এসব বলতে থাকে আর মারতে থাকে। একটা কথাও বলার সুযোগ দেয়নি ওরা। বেল্ট খুলে এবং রড় দিয়ে আমাকে মারতে শুরু করে।
একপর্যায়ে তাঁরা বলে, তোরে তিনটা অপশন দিলাম- ১) তুই মার খাবি ২) দুই লাখ টাকা দিবি ৩) তুই প্রক্টর অফিসে যাবি। আমি বললাম, প্রক্টর অফিসেই যাবো। এই শুনে ওরা আমাকে আবার মারতে শুরু করে। একপর্যায়ে আমি সহ্য করতে না পেরে টাকা দিতে রাজি হলে তাঁরা আমার কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। তাঁরা আমার ফোন নিয়ে পাসওয়ার্ড শুনে বিকাশ ও রকেট থেকে টাকা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু টাকা নিতে পারেনি।
এর আগে রুমে ডাকলে আমি আমার এক বন্ধুকে ম্যাসেজ করে জানাই। পরে আমার কিছু বড়ভাই বন্ধু আমাকে ফোন দিতে শুরু করে। এসময় রুমে নীল পাঞ্জাবি পরা একজন আসে তাকে আমি চিনি না। এরপর তাঁরা বলে তুই স্বীকার করবি তুই ভর্তি বাণিজ্যের সিন্ডিকেট চালাস, তোদের হোতা কে সব বলবি, আমরা ভিডিও করতেছি। এরপর তাঁরা ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে এবং চাকু বের করে পায়ে ধরে বলে, এবার তুই স্বীকার করবি। পরে আমি ভয়ে স্বীকার করে দেয়। এরপর তাঁরা আমাকে পাশের রুমে শিফট করিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে সেই রুমে তালা দিয়ে দেয় এবং বাসায় ফোন দিয়ে টাকা পাঠাতে বলে।
অভিযুক্ত শিক্ষার্থী শোয়েবের কাছে চাদা দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কাউকে রুমে আটকে রেখে চাদা দাবি করেছি বা মেরেছি এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন। এমনকি এ ব্যাপারে আমি জানিও না। আমার সাথে ইসমাইলের কোন দ্বন্দ ও নেই। এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট। আমাদের ২০১৮-২০১৯ সেশনের আজ ইফতার মাহফিল ছিলো এজন্য আমরা রুমে কথা বলছিলাম। এরমধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইপিই বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মারুফ ভাই, রনি ভাই ও নোমান ভাই আমাদের রুমে ঢুকে আমাদেরকে হুমকি দেয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী সালমান বলেন, ইসমাইল আমাদের বন্ধু তাকে মারব এটা কোনভাবে সম্ভব না। আজকে আমাদের বর্ষের ইফতার মাহফিল ছিলো তাই এ ব্যাপারে ওর সাথে কথা বলছিলাম। এরমধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন বড় ভাই আমাদের রুমে এসে আমাদেরকে গালিগালাজ করে ও বিভিন্ন ভাবে হয়রানি করে। আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট।
এবিষয়ে আইপি বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী মারুফ হাসান সুকর্ণ বলেন, আমি টিউশনিতে থাকা অবস্থায় নোমান (আমার এলাকার ছোট ভাই) আমাকে ফোন দিয়ে জানায় আমার এলাকার অন্য এক ছোট ভাইকে (ইসমাইল) হলে আটকে রেখে কিছু শিক্ষার্থী মারধর করছে। আমি তৎক্ষণাৎ টিউশনি রেখে রনি ও নোমানকে সাথে নিয়ে হলে এসে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করি। এ সময় ও অনেক ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলো। এমনকি রুমে প্রবেশের সাথে সাথে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আমাকে জড়িয়ে ধরে আশ্রয় চায়। এছাড়া তারা আমাদের ব্যাপারে হুমকি দেওয়ার যে অভিযোগ করেছে তা ভিত্তিহীন। এমনকি শোয়েব আমাকে মারার জন্য উদ্যত হলে রনি ও নোমান ওকে থামায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু শিক্ষার্থী জানান, এদের বিরুদ্ধে এরকম জিম্মি করে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ আগেও ছিলো এবং এরা এগুলো করেছে তা অনেকেই জানে।
এ বিষয়ে হলের প্রভোস্ট ড. আশরাফুজ্জামান জাহিদ বলেন, আমরা বিষয়টি জানা মাত্রই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে হল অফিসে নিয়ে এসে শরীরে আঘাতের চিহ্ন পেয়েছি। তৎক্ষনাৎ তাঁকে যশোর সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছি এবং তাঁর চিকিৎসার সকল খরচ হল প্রশাসন বহন করবে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর নিয়মানুযায়ী হল থেকে ব্যবস্থা নেবো।
এবিষয়ে যবিপ্রবি উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, যবিপ্রবির শহীদ মশিউর রহমান হলের ৫২৮ নং রুমে এক শিক্ষার্থীকে কিছু শিক্ষার্থী আটকে রাখার ঘটনা জানার সাথে সাথে প্রভোস্ট বডি সেখানে গিয়ে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে। আমি প্রভোস্ট বডিকে নির্দেশ দিয়েছি ঐ রুম সিলগালা করে দেওয়ার জন্য এবং অভিযুক্ত শিক্ষার্থী যদি আবাসিক হয় তাহলে হল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করার জন্য। এছাড়া অভিযুক্ত শিক্ষার্থী যদি পুলিশকে ইনফর্ম করে তাহলে যবিপ্রবি কতৃপক্ষ সঠিক ব্যবস্থা নিবে।
এমএইচআর