সপ্তাহ ধরে ক্লাস-পরীক্ষা আর এসাইনমেন্টের ধকল, ফার্স্ট গেট থেকে সেকেন্ড গেটে দৌড়াদৌড়ি, হল থেকে ক্যাম্পাসে ছুটোছুটি, দিনের শেষে টিউশনিতে বুদ হয়ে থাকা অতঃপর শেষ রাতে ক্লাসের হিজিবিজি নোটে মুখ গুজে রাখা। এভাবেই বছর কাটে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের(পবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের। দিনের শেষ লগ্নে প্যারিস রোডে কিংবা নীল কমল দিঘীর পাশে বুক ভরে একটু শ্বাস নিতে চাইলেও হয়তো হয়ে ওঠে না। এতো হাসফাসের ভিড়ে ছুটে চলা মন প্রহর গোনে কবে ফিরে যাওয়া হবে ক্ষণিকের জন্য নিজের বেড়ে ওঠা নীড়ে। একসময় অপেক্ষার পালা শেষ হয়, বছর ঘুরে চলে আসে আরেকটা ঈদ। সময় আসে ব্যস্ততার রুটিন ফেলে কিছু অলস দুপুর কাটানোর, সাথে প্রিয় মানুষ গুলোর সঙ্গ। সে আশাতেই আমরা টিকিটের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াই, বিস্তর ধাক্কাধাক্কি হয়। আমার হৃৎপিণ্ড ছলকে ওঠে। যাচ্ছি তাহলে এবার? কিন্তু একটা লম্বা স্থবির অজগরের মতো মহাসড়ক আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে।
তবু আমরা যেতে চাই বাড়ি। একটু বিরতি পেলেই ছুটে যেতে চাই। ক্লান্তক্লিষ্ট শরীরে এলিয়ে পড়তে চাই নিজের পুরোনো ঘরে, পুরোনো বালিশ আর বিছানায়, পুরোনো ঘ্রাণের ভেতর। কিছু কল্পনা আর কিছু আধো-অন্ধকার বাস্তবতার ভেতর। মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য হলেও মনে হয় আমরা শ্বাস নিচ্ছি, মনে হয় বেঁচে আছি, কী বিস্ময়, আজও বেঁচে আছি!
ঈদের এই ছুটিতে পরিবারের সাথে কেমন সময় কাটছে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের? সেটাই আজ জানার চেষ্টা করবো…..
ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ৮ম সেমিস্টার পড়ুয়া শিক্ষার্থী মো. আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, আপন আঙ্গিনা, আপন মানুষগুলো ছেড়ে ভার্সিটিতে ক্লাস,পরীক্ষা, রিপোর্ট, অ্যাসাইনমেন্ট এই যান্ত্রিক ব্যাস্ততায় হৃদয়টা ক্লান্ত হয়ে যায়,শীতল নীড়ে ফেরার জন্য ছটফট করতে থাকে।
তাই ঈদের ছুটি আমার কাছে যেনো দারুণ খরায় প্রশান্তিময় অঝোর বৃষ্টি। পরিবারের সবার সাথে, মা আর বোনের হাতে তৈরী খাবার দিয়ে সাহরি-ইফতার করা যেন স্বর্গীয় তৃপ্তি এনে দেয়। ভাগ্নে, চাচ্চুদের সাথে দুষ্টামি, ওদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, পরিবার-স্বজন সবাইকে সাথে নিয়ে ঈদের শপিং করতে যাওয়া অদ্ভুত রকম সুখ এনে দেয় । রাতে আড্ডাবাজি, লুডু খেলা, হৈচৈ যেন পাখির কলকালির মতো হৃদয় শান্ত করে। আম্মুর কাজে টুকটাক সাহায্য করা, বাজার করে দেয়া এগুলো আমাকে বাড়তি আনন্দ দেয়। মা আর বোনদের যত্নে নিজেকে রাজপুত্রের মতো মনে হয়, আরাম আয়েশ করে দিব্যি পার করে দেয়া যায়। অথচ ক্যাম্পাসে ফিরলে মায়ের রাজপুত্র হয়ে যায় জনৈক প্রজা।
মার্কেটিং বিভাগের মাস্টার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল রায়হান বলেন, দীর্ঘ ৫ মাস পর বাড়িতে আসলাম। এখানে সবই যেন রূপকথার মতো, মাকে মনে হয় রূপকথার পরীর মতো যা খেতে চাই তা মুখ ফুটে বললেই হাজির হয় কোনো বাঁধা নেই। বাবা যেন আলাদিনের প্রদীপ, ঘষা দিলেই যেন টাকা। মাঝে মাঝে না বলেও নিয়ে নেই তার পকেট থেকে। এখানে কোনো চিন্তা নেই কখন কি খাবো, ভোরের ক্লাসের ঝামেলা নেই, এ্যাসান্টমেন্ট নিয়ে চিন্তা নেই, হঠাৎ স্যারের ফোন আসার ভয় নেই এই বুঝি বললো, আছো? রাত ৮ টায় অনলাইন ক্লাস, অফলাইনে দিনে তো হয় ই। এখানে নিজের কিছু লাগলে কাজের জন্য ছোট ভাই বোন আছে সর্বদা হুকুমের অপেক্ষায়। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে বন্দিশালা থেকে বেরিয়ে, কোনো এক স্বর্গ রাজ্যে এসে বসবাস করছি।
আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী তালুকদার মোঃ শাহজালাল শরীফ বলেন, ক্যাম্পাস জীবন যখন থেকে শুরু করেছি তখন থেকে জীবনে বৈচিত্র্যময় কিছু মুহুর্তের আগমন ঘটেছে।
বিশেষ করে রমাদানে বেশ কিছু বৈচিত্র্যতা কাজ করে। বিশেষ করে সারাদিনের ক্লাস,পরীক্ষা অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রাক্টিক্যাল শেষে বন্ধুরা সবাই মিলে ইফতার করা, একসাথে তারাবীহ সালাত আদায় করতে যাওয়া, তারাবীহ শেষ করে কোমল পানিয় ভাগাভাগি করা। কিন্তু তার পাশাপাশি বাড়ির কথা মনে পড়ে, পরিবারের প্রিয় মুখগুলো ভেসে ওঠে। তখন মনে হয় যে কখন বাড়ি যাবো কখন পরিবারের সঙ্গে ইফতার সেহরি করবো।
অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত ছুটির দিন। প্রিয় বন্ধুদের একে অপরকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্য। বাড়িতে পৌঁছে যখন তাদের আমার জন্য অপেক্ষমান চেহারা আর আনন্দের ঝিলিক দেখি তখন যেম মনের সকল ক্লান্তি বাতাসে মিলিয়ে যায়।
দেখতে দেখতে ঈদের দিন প্রায় চলে এলো, পরিবারের সঙ্গে ঈদ করা আর পাশাপাশি বন্ধুদের খুব মিস করছি। তাই ছোট্র এই লেখার মাধ্যমে তাদের ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে দিলাম।
ঈদের ছুটিটা পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে অবশেষে ক্যাম্পাসে ফেরার দিন আসবে।
রক্তের বাঁধন কে বিদায় জানিয়ে আবার ছুটতে হবে সেই এর প্রিয়মুখ গুলো দেখার জন্য। আর সাথে ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রাক্টিক্যালের ঝনঝনানি তো আছেই।
আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদের ৪র্থ সেমিস্টারে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী মীর মো: নূরুন্নবী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ক্লাস, পরীক্ষা, এসাইনমেন্টের চাপ রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো করোনা মহামারী। করোনা ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য দ্রুত একাডেমিক কার্যক্রম শেষ করার তাড়া রয়েছে। তাই, অনেক সময় আমাদের ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও বাসায় যাওয়া হয় না।আর একাডেমিক ব্যস্ততার পাশাপাশি খেলাধুলা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রোগ্রাম তো লেগেই থাকে।
পরিবারই আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল। যেখানে আসলে সকল দুঃখ-কষ্ট, হতাশা, ব্যর্থতা ভুলে যাই। নতুন করে জীবন পরিচালনা ও স্বপ্ন দেখার ইচ্ছা জাগে। আর ইদের ছুটিতে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, পরিচিত-অপরিচিত সকলের সাথে দেখা হয়। পরিবারের সাথে মিলে-মিশে থেকে ইদ উদযাপন আমাদের আনন্দকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। আর ইদের ছুটি যেন আমাদের জীবনে আশীর্বাদস্বরূপ। অগ্রিম ইদের শুভেচ্ছা।
খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের ৮ম সেমিস্টারে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ফজলে রাব্বি বলেন, ঈদে বাঙ্গালী শত-সহস্র ব্যস্ততায়ও বাড়ি ফেরবে না তা কল্পনাতীত! প্রতিবছর যাত্রা পথের প্রচন্ড দূর্ভোগ স্বত্তেও নাড়ীর টানে বাড়ি ফেরার এক মহারণ দেখা যায়।
আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। সারা বছর ক্লাস, এসাইনমেন্ট, মিড-টার্ম, ফাইনাল সহ ক্যাম্পাসের শক্ত সূচিতে দুই একটা ছোটখাটো ছুটি থাকলেও বাসায় আসার সেরকম সুযোগ হয়ে উঠে না, ব্যস্ততায় হলেই কেটে যায় সময়টুকু।
তবে ঈদের ছুটি একদমই ভিন্ন। এইতো ধরুন, রমজানে মিড-টার্ম পরিক্ষার সাথে ক্লাস, বাধ্য হয়ে দায়সারা ইফতার-সেহরি। শুধু অপেক্ষায় ছিলাম কবে ছুটি শুরু হবে, বাসায় মা-বাবা, ভাই-বোন স্বপরিবারে ইফতার, গ্রামের মসজিদে তারাবি, আর তর সইছিলো না।
অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ছুটি এলো, বাসায় ফিরে প্রতিদিন ইফতারে মায়ের হাতের সেই চিরচেনা পেয়াজু, বেগুনি আর চপ যেন অমৃত। আর কিছুদিন পরেই এক সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিবো, ভাবতেই প্রাণ জুড়ানো প্রকাশ উর্ধ্ব এক স্বর্গীয় সুখ!
যদিও ঈদের ছুটির পরেই সেমিস্টার ফাইনাল, তবে এই আনন্দের মাঝে এসব ভাবার সময় কই!
আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদের ৮ম সেমিস্টারে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী মো: আনিছুর রহমান বলেন, মায়ের আঁচল ছেড়ে বের হওয়া সন্তান চাইলেও সহজে আর সেই আঁচলে ফিরে যেতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শুরু করার সাথে সাথে আমরা যে স্বাধীনতা পাই সেখানে সব থাকলেও নেই পরিবারের ছোঁয়া। সারাদিনের ক্লাস, ল্যাব, এসাইনমেন্ট, সংগঠন, পরিক্ষা, আড্ডা, টিউশনির ভিড়ে পরিবারের কথা মনে আসলেও মস্তিষ্কে বেশিক্ষণ জায়গা দেওয়া যায় না। চাইলেই ছুটে আসা যায় না পরিবারে কাছে, মায়ের আঁচলের নিচে। তবুও এই দূরত্ব ভেঙে নিজেকে বাঁধতে ইচ্ছে করে মায়ের সেই নরম আঁচলে। ইদের ছুটি আমাদের সাময়িকের জন্য সেই স্বর্গীয় সুখ পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। সকল ব্যস্ততা উপেক্ষা করে আমরা ফিরে আসি পরিবারের কাছে। মায়ের ভালোবাসা, বাবার স্নেহ, ছোট ভাই-বোনের আবদার, এলাকার বন্ধুদের সাথে আড্ডা, সব যেন স্বপ্নের মতো সুন্দর। শুরু হয় ফিরে আসা আর ফিরে পাওয়ার বাধ ভাঙ্গা উৎসব। এই ফিরে আসার আনন্দ যেনো, রাজ্য হারিয়ে ফিরে পাওয়া কোনো রাজার আনন্দ। মায়ের ভালোবাসা, বাবার স্নেহ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক সন্তানের মনে এই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক।
আরএস