গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের কয়েকদিনের মাথায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন ড. এএফএম আব্দুল মঈন। সেই সাথে পদত্যাগ করেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবির সহ প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, প্রভোস্টসহ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা অনেক শিক্ষকই।
প্রশাসনিক শীর্ষ এই পদগুলো এক মাসের বেশি শূন্য থাকায় স্থবির হয়ে আছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম। এমন পরিস্থিতিতে দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে উপাচার্য পদ বাগিয়ে আনতে দৌড় ঝাপ করছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএম শরীফুল করীম। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে সহকর্মীকে হেনস্তা-মারধরসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ।
এছাড়াও শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসে রাজনীতিতে সক্রিয়তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের সাথে শো-ডাউন ও ছাত্রশিবিরের নেতাদের সাথে বৈঠকের অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও উপাচার্য হওয়ার মত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অংশীজনরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১০ সালে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মাহফুজুর রহমানকে তৎকালীন উপাচার্য জেহাদুল করিমের কক্ষে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা ও মারধর করেন শরিফুল করিম। এই ঘটনার শাস্তি স্বরূপ তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই বছরের জন্য অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এরপর ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইংরেজি বিভাগের পূর্বনির্ধারিত সান্ধ্যকালীন কোর্সের (ইভিনিং ইন মার্স্টাস-ইএমএ) প্রশ্ন মডারেশনকে কেন্দ্র করে নিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবুল হায়াতকে গাল-মন্দ করেন ও মারতে উদ্ধত হন। এই ঘটনার সাত বছর পেরোলেও বিচার পাননি অভিযুক্ত শিক্ষক। কিন্তু গত বছর অভিযোগপত্রটি তুলে নেন আবুল হায়াত।
এছাড়াও তার বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে কলা অনুষদের ডিন থাকাকালীন উপাচার্যের পছন্দের প্রার্থী ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রেঁনেসা আহমেদ সাইমার নিয়োগে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠে।
সরকার পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০তম সিন্ডিকেট সভায় সকল ধরনের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও উপাচার্য হওয়ার জন্য নিজ কক্ষে নিয়মিত ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সাবেক-বর্তমান নেতাদের সাথে বৈঠক করছেন তিনি। ছাত্রদলকে নিয়ে ক্যাম্পাসে দিয়েছেন শো-ডাউন।
গুগল স্কলার এবং রির্সাচগেটের তথ্য অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে মাত্র ৫-৬ টি গবেষণা রয়েছে। সেখানে একটি মাত্র গবেষণার জার্নাল সিমাগো র্যাংকিং রয়েছে। বাকি গবেষণাগুলো বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে যা ভালো কোনো র্যাংকিং নেই।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সাথে তার একটি ছবি প্রকাশ পায়। যেখানে আওয়ামিলীগের অন্য কয়েকজন নেতাকেও দেখা যায়। এছাড়াও হাসিনা সরকারের আমলে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সাথে তার আঁতাত ছিল বলে অভিযোগ অনেকের। অভিযোগ আছে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের কাছে বর্তমানে ভরসাস্থল হয়ে উঠেছেন তিনি। আশ্বস্ত করেছেন উপাচার্য হতে পারলে তাদেরকে সাথে নিয়েই করবেন সব কাজ। তাই আওয়ামীপন্থি শিক্ষকেরাও চান তিনি ভিসি হিসেবে আসুক।
এছাড়াও গত ১১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর গুলির নির্দেশদাতা সাবেক প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে তার বাসায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক রুবেল হোসাইন বলেন, আমরা আন্দোলন করে স্বৈরাচারকে হটিয়েছি যাতে অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কেউ আগের মতো রাজনৈতিক প্রভাব আর লবিংয়ের জোরে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসতে না পারে। সেই জায়গা থেকে একজন একাডেমিশিয়ান এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ভিসি আমাদের সবারই প্রত্যাশা। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপে আমি একটা পোস্ট করি। এরপর থেকেই আমাকে বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি ধামকি দেয়া হচ্ছে। পোস্ট ডিলিটের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। বর্তমান এবং সাবেক কয়েকজন শিক্ষার্থী ব্যক্তি আক্রমণও করেছে। ক্যাম্পাসে গেলে আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়।
এছাড়া তিনি আরও বলেন, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আমাকে এক ধরনের আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে যারা যারা আমাকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে এবং নানা ধরনের আক্রমণাত্মক মেসেজ দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-২০১৮ বর্ষের শিক্ষার্থী খালিদ বিন ওয়ালিদ বলেন, পূর্বের উপাচার্যরা সবসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং একদল চাকরিপ্রার্থীদেরকে দিয়ে নিজেদের বলয় তৈরি করে ক্যাম্পাসে অনিয়ম-দুর্নীতি জারি রাখতেন। শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতির বলয় তৈরি করে অবৈধ কাজ করতেন। এখন নতুন ভিসি হওয়ার জন্য যিনি দৌড়ঝাঁপ করছেন দেখছি, তিনিও তাদের মতোই ছাত্রদল-শিবিরের সাবেক নেতাদের নিয়ে বলয় তৈরি করছেন। মিটিং শোডাউন দিচ্ছেন। অনেকটা বলা যায়, মানুষ পরিবর্তন হচ্ছে শুধু, কিন্তু পরিবেশ পরিবর্তন হচ্ছে না। এটা ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেয় না।
শিক্ষকদের মারধরের বিষয়ে অধ্যাপক ড. এমএম শরিফুল করিম বলেন, আগে যেসব ঘটনা ঘটেছে দু’পক্ষের কারণে ঘটেছে। মাহফুজ স্যারকে মারধর করিনি বিনা কারণে, উনিসহ আরো কয়েক কতিপয় শিক্ষক তৎকালীন উপাচার্য জিহাদুল করিম স্যারকে অবরুদ্ধ করেছিলো বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করে। তখন আমি উপাচার্যকে রক্ষা করতে গেলে একটা হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
ছাত্রদলের সাথে শো-ডাউন ও শিবিরের সাথে মিটিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, সবাই আমার ছাত্র, আমি কারো কাছে যাই না, কে কোন দল করে তা খেয়াল রাখিনা। আমার সাথে অনেকে দেখা করতে আসে শিক্ষক -শিক্ষার্থীর জায়গা থেকে।
উপাচার্য হওয়ার বিষয়ে ড. শরিফুল করিম জানান, উপাচার্য হওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১১ জন প্রথম শ্রেণীর অধ্যাপকের তালিকা নেওয়া হয়। তবে শর্ত হচ্ছে সাবেক সরকারের সমর্থক হতে পারবেনা, যেহেতু আমি নীল দল করি নাই তাই আমার নাম আছে ওই লিস্টে। তবে উপাচার্য হতে হলে চারটা ক্রাইটেরিয়া আছে। আমি মনে করি আমার এই বিষয়গুলো আছে। একাডেমিশিয়ান হতে হবে, প্রশাসনিকভাবে দক্ষ, শিক্ষক শিক্ষার্থী কর্মকর্তা কর্মচারীর সাথে সুসম্পর্ক ও সাবেক সরকারের পক্ষের লোক হওয়া যাবেনা। আমি মনে করি সব গুলো ক্রাইটেরিয়া আমার পূর্ণ হয়েছে।
বিআরইউ