শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি তীর্থ দাসকে

শওকত জাহান, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২৪, ০৩:০৮ পিএম
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি তীর্থ দাসকে
  • হতে চান সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার
  • তীর্থ দাসের স্বপ্ন পূরণে পাশে সবাই

জীবন যুদ্ধে হার না মানা জয়ী এক যোদ্ধার নাম তীর্থ দাস। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও অসীম সাহস, অধ্যবসায় এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা ও সঠিক মনোবল দিয়ে কোনো স্বপ্ন পূরণই অসম্ভব না।

পাশাপাশি অন্য তীর্থদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজলার সুনীল চদ্র দাস ও তাপসী দাসের বিয়ের ৫ বছর পর ২০০৫ সালে তাদের কোল জোড়ে আসে পুত্র সন্তান তীর্থ দাস। স্বাভাবিক আট দশজন শিশুর মতো স্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে উঠলেও সাত বছর বয়সে পায়ের গোড়ালিতে সমস্যার কারণে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তারা জানান, শিশুটি ডুসনি মাসকুলার ডিষ্ট্রফি (ডিএমডি) নামকজটিল জেনেটিক রোগে আক্রান্ত।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই রোগ আক্রান্ত শিশুদের উন্নত চিকিৎসা এখনা শুরু হয়নি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই রোগ আক্রান্ত শিশুরা পঙ্গুত্ব ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে থাকার পাশাপাশি বয়স ১৫ হবার পর বাচার সম্ভাবনা থাকে কম। দুঃস্বপকে  তাড়া করে এই দম্পতি তাদের সন্তান নিয়ে চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমায় ভারতে। সেখানকার ডাক্তারদের চিকিৎসায় স্বপ্ন বুনতে শুরু করে মধ্যবিত্ত বাবা-মা। পঙ্গুত্ব থেকে বাঁচানো সম্ভব না হলেও চিকিৎসা চলমান থাকলে তীর্থ দাসের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখান চিকিৎসক।

ডাক্তাররা তখন তাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন পঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয় এবং তার জীবনকালও খুব দীর্ঘ হবে না তখনও তার মা তাপসী দাসের অদম্য মনোবল ও ভালোবাসা তাকে কখনোই থামতে দেয়নি।

অসুস্থতাকে পাশে ফেলেই অদম্য তীর্থ দাস ২০২০ সালে জিপিএ ৫.০০ পেয়ে এসএসসি পাশ করেন। কলেজে উঠার পর তার দু’পায়ের শক্তি না থাকায় হুইল চেয়ারই তার সঙ্গী হয়। এতো প্রতিকূলতার মাঝেও স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায়নি তীর্থ দাস।

কলেজ থেকেই তার স্বপ্ন ছিল কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করে হবেন একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।  এরপর ২০২২ সালে ধনবাড়ী কলেজ থেকে এ প্লাস নিয়ে এইচএসসি পাশ করার পর গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবন্ধী কোটার সুযোগ না নিয়ে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে মেধাতালিকায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন তীর্থ দাস।

কলেজ থেকেই এখনো পর্যন্ত তার মা তাকে হুইল চেয়ারে করে ক্লাসে আনা-নেওয়া এবং পরিচর্যা করেন। তার মা এবং পরিবারের অন্যরা পুরোটা দিয়ে তীর্থের স্বপ্ন পূরণে বাতিঘর হিসেবে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে তীর্থ দাস আমার সংবাদকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমি আমার পরিবারের সবাইকে পাশে পেয়েছি। অনেক আগে থেকেই আমার কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল। এখন সেটা পূরণ হয়েছে যদিও এখন পড়াশোনার চাপ আর শারীরিক কষ্ট বেড়েছে। আমি ভবিষ্যতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই।

নিজের অসুস্থতার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথমদিকে আমার এতো সমস্যা ছিল না, স্বাভাবিক মানুষের মতোই হাঁটতে পারতাম। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উঠার পরে আমার এই সমস্যা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। তখন আমাকে কোলে করে নিয়ে বসাতে হতো। চিকিৎসার জন্য চেন্নাইতে গেলে ঐখানে পায়ে একটা বেল্ট দেয় যেটার সাহায্যে একটু হাঁটতে পারতাম। ভর্তি পরীক্ষার সময় থেকে আমার হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতে হয়।

মা তাপসী দাস বলেন, আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল বড় হওয়ার এবং আমি তাকে কোনোদিন সেই স্বপ্ন দেখতে বাধা দিইনি। চিকিৎসকরা যখন বলেছিল, বেঁচে থাকার কোনো আশা নেই তখনও আমরা থামিনি। আজ আমার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এটা তার কঠোর পরিশ্রম এবং আমাদের অবিচল সমর্থনের ফল।

এ ব্যাপারে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. সুজন আলী বলেন, তীর্থ দাস শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার যারা তাদের জন্য কোটা থাকলেও গত গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় তীর্থ মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তার এসএসসি, এইচএসসি ফলাফলও অনেক ভালো। বিভাগের সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারী তার বিষয়ে অবগত এবং তার অ্যাকাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করতে সবাই তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করবে বলে একমত হয়েছি এবং হুইল চেয়ারে করে সিঁড়ি বেয়ে উঠা কষ্টকর হওয়ায়, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ক্লাসগুলো নিচতলায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।

ইএইচ