জুলাই বিপ্লবের বিরোধিতা করেও দাপটে বেরোবির ‘আওয়ামীপন্থি শিক্ষক’ গোলাম রাব্বানী

বেরোবি প্রতিনিধি : প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৪, ১২:৫৮ পিএম
জুলাই বিপ্লবের বিরোধিতা করেও দাপটে বেরোবির ‘আওয়ামীপন্থি শিক্ষক’ গোলাম রাব্বানী

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের( জুলাই বিপ্লবের)  বিরোধিতা করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব জায়গায় দাপটে দাবিয়ে বেড়াচ্ছেন  বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও কট্টর আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের দল ‍‍`নীল দল‍‍`র সাবেক সভাপতি ও সাবেক প্রক্টর গোলাম রাব্বানী। এখনো রয়েছেন সকল প্রকার ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তিনি নিজেকে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন দাবি করলেও ১৫ জুলাই‍‍` র প্রথম পহরে (১৪ জুলাই রাত ১:২১ টায়) নিজের ফেসবুক ওয়ালে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদমূলক স্লোগান  "তুমি কে আমি কে,রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, সরকার সরকার " স্লোগানকে বিক্রীত করে শিক্ষার্থীরা নিজেদের রাজাকার দাবি করে স্লোগান দিয়েছেন বলে এই স্লোগানের প্রতিবাদস্বরূপ নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে   স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী‍‍` র ছবিসহ "তুমি কে আমি কে,বাঙালি বাঙালি " ক্যাপশান দিয়ে একটি পোস্ট করেন। সরকার পতনের পর সেই ফেসবুক পোস্টটি ডিলিট করে দেন।

পোস্টের কমেন্টে তিনি তৎকালীন  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের  রাজাকার বলেননি বলে দাবি করে বলেন, ‘আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোথায় বলেছেন আন্দোলনকারীরা রাজাকার। আমি তো খুঁজে পেলাম না। তাদের ‘রাজাকার’ শব্দের মাধ্যমে প্রতিবাদের ভাষার সাথে আমি একমত নই। আমি ঘৃণা ভরে তা প্রত্যাখান করছি।’
এছাড়া তিনি শিক্ষার্থীদের অনেকটা হুমকি দিয়ে লিখেন, ‘প্রত্যেকে তার কর্মফল ভোগ করবে, অতীতেও করেছে, ভবিষ্যতেও করবে।’

তিনি আরেকটি কমেন্টে পাঁচ অক্ষরের একটি ইংরেজি শব্দ দিয়ে রাজনৈতিক ভাষায় লিখেন,"মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রীর ছবি দেখছেন না।" তিনি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে আরও লিখেন, ‘দু-দিন পরে এদেশের চেয়ারে বসতে তারা কি লজ্জাও পাবে না?’

তার পোস্টে  নুর নবি মিয়া নামের একজনের  কমেন্টের প্রতিউত্তরে তিনি লিখেন, Nur Nabi Miah দেখুন, কোমল মতি শিক্ষার্থীগণের দাবি আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হলে আমি এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন করতাম না। আমি নিজে মনে করি কোটার যৌক্তিক সংস্কার হওয়া উচিত। কিন্তু কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কোনোরকম অনুশোচনা ছাড়া ‍‍`রাজাকার‍‍` স্লোগান দিতে পারে না।‍‍`রাজাকার‍‍`রা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে আর স্বাধীন বাংলা দেশের বিপক্ষে। আজকে যে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিলো, সেই ‍‍`রাজাকার‍‍` শব্দটি স্বাধীন বাংলা দেশের ইতিহাসে একটা ঘৃণ্য শব্দ (মির জাফরের মতো ঘৃণ্য শব্দ) । প্রতিবাদের ভাষা এরকম জঘন্য হতে পারে না।

এরপর  তারা যখন সেই দেশের চেয়ারগুলোতে বসবে তখন কি লজ্জাও লাগবে না। আমি তাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের বিপক্ষে ছিলাম না। কিন্তু  তাদের‍‍` রাজাকার ‍‍` শব্দের মাধ্যমে প্রতিবাদের ভাষার সাথে আমি একমত নই।  আমি ঘৃণা ভরে তা প্রত্যাখান করছি।প্রত্যেকে তার কর্মফল ভোগ করবে, অতীতেও করেছে, ভবিষ্যতেও করবে।

সেটা সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং তাদের শান্তিপূর্ণ যৌক্তিক আন্দোলনকে সাপোর্ট করা মানে এই নয় তাদের সবকিছুর দায় আমাকে নিতে হবে।আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোথায় বলেছেন আন্দোলনকারীরা রাজাকার। আমি তো খুঁজে  পেলাম না, থাকলে  দয়া করে আমাকে ভিডিও টা দেবেন কি? আমিও একটু দেখতে চাই।

আমি ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে এটা জানি মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন লিস্ট আছে রাজাকারদেরও লিস্ট আছে( যদিও সকল রাজাকারের লিস্ট সংরক্ষিত আছে বলে আমার জানা নেই)।সেই রাজাকারদের সন্তান বা নাতি- নাতনিরা তো সত্যি কোটা পাবেনা। কারণ ‍‍`রাজাকার‍‍` নামে তো কোটা নেই এবং এটা সম্ভবও নয়। ধরুন, কারোও দাদা বা বাবা রাজাকার, তার জন্যও কিন্তু মেধার অংশ উন্মুক্ত রয়েছে। আন্দোলনকারীরা রাজাকার এটা তো শুনিনি।

আমার চিন্তা ধারা আপনার সাথে না মিললেই কি আমি পা চাটা হয়ে গেলাম। আপনার উদ্দেশ্য আমাকে শাস্তি দেওয়া  হলে এ প্রসঙ্গে আর  আলোচনা করবনা।কারণ আপনি ইতোমধ্যে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছেন। যাহোক কোটা আন্দোলন নিয়ে আজকের পরে আর কথা বলতে চাইনা। আমি কথা  বললেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও শিশু মুক্তিযোদ্ধারা যেমন বহাল তবিয়তেই থাকবে তেমনি এই নির্লজ্জ স্লোগান দেওয়ার পর কোটা আন্দোলন কে সমর্থন না করলেও তারা তাদের কাজের জন্য লজ্জিত হবে না। ধন্যবাদ ভালো থাকবেন।"

এ বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেরোবি শিক্ষার্থী তুহিন রানা বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরেও আবু সাঈদের ক্যাম্পাস বেরোবি স্বৈরাচার মুক্ত হতে পারেনি। স্বৈরাচারের দোসর শিক্ষকদের আ. লীগ পন্থি  নীল দলের সাবেক সভাপতি এবং সাবেক প্রক্টর গোলাম রব্বানী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েই গেছে। গোলাম রব্বানী ছিলেন, সাবেক উপাচার্য ড. হাসিবুর রশীদের প্রধান প্লানিং মাস্টার। তিনি প্রক্টরের পদ ফিরে পাওয়ার আশায় বিভোর ছিলেন। ১১ জুলাই থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত ছাত্র নির্যাতনের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন এই সাবেক প্রক্টর। তিনি ছাত্রলীগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া যুবলীগ নেতা ওয়ার্ড কমিশনার শিবলুর নেতৃত্বে অস্ত্রধারী ক্যাডারদের ক্যাম্পাসে ঢুকান। স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ব্যাপক অর্থ ব্যয় করেন এই শিক্ষক।

তুহিন রানা আরও বলেন, ১৫ জুলাই সাবেক স্বৈরাচার সরকার যখন ছাত্র জনতাকে রাজাকার বলে গালি দেয় সেই দিনই এই শিক্ষক তার ফেসবুক পেজে ছাত্রলীগকে সমর্থন করে একটি পোস্ট করেন। শহীদ আবু সাঈদ হত্যা কাণ্ডের পর ১৭ তারিখ ও পরবর্তীতে যে-সকল শিক্ষক উপাচার্য, প্রক্টরিয়াল বডি ও ছাত্র উপদেষ্টা‍‍`র বিচারের দাবি করেছেন এই ধরনের ১০ জন শিক্ষকসহ ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নেন। এই  শিক্ষক ৪ আগস্ট গণহত্যার পক্ষে স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে ছাত্র জনতার আন্দোলনকে বিএনপি জামাতের আন্দোলন দেখিয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট করেন। যা একজন শিক্ষকের কাছে আশা করা যায় না। স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট এই গোলাম রব্বানী প্রক্টর হবার জন্য ব্যাপক লবিং করেন। তার ১৫ জুলাই ও ৪ আগস্টের পোস্ট স্পষ্ট গণহত্যাকে সমর্থন করে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এতসব করার পরেও কার মদদে তিনি ক্যাম্পাসে এখনো দাপটে চলেন এটাই ভাবার বিষয়।

একটি সূত্র জানায়, শিক্ষক রাব্বানী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিভিন্নভাবে তার বিভাগের  শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে বাঁধা দিয়েছেন।এ বিষয়ে ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থীর সাথে একজন ছাত্র প্রতিনিধি যোগাযোগ করলে  ঐ শিক্ষার্থী  বলেন, "এই তথ্যগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনারা আমাকে একটু এড়িয়ে গেলে ভালো হয়।কারণ আমার আর একটা সেমিস্টার আছে,আমার মাস্টার্স পাশ করতে হবে।"

এ বিষয়ে শহীদ আবু সাঈদের সহযোদ্ধা রোবায়েড হোসেন বলেন, ‘আমি একজন আন্দোলনকারী হিসেবে মনে করি যেসব ফ্যাসিস্টদের দালাল আন্দোলনের সমর্থন করেনি তারা বরং যারা সমর্থন করছে তাদের হয়রানি করার জন্য মামলা করার উদ্যোগ নিয়েছিল। শহীদ আবু সাঈদের এই ক্যাম্পাসে তাদের দাপটে চলাফেরা করা ক্যাম্পাসের জন্য লজ্জাজনক। এত বছর যিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অরাজকতা  সৃষ্টি করেছেন তিনি এখনো কার ইন্ধনে ক্যাম্পাসে দাপটে চলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এর দ্রুত তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আমরা আশাবাদী।’

এ বিষয়ে আবু সাঈদের সহযোদ্ধা শামসুর রহমান সুমন বলেন, ‘শিক্ষকগণ দলীয়করণ হয়ে যাবার ফলে তাঁরা যতটা না শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করেন তার থেকে বেশি চিন্তা করেন লেজুড়বৃত্তিক সেই দলের কথা। ফলতঃ নৈতিক স্খলন এবং ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের দৈন্য দশা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় আইনে তা নিষিদ্ধ থাকলেও মানেন না অনেকেই।আশা করি নতুন প্রশাসন এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন।’

সূত্র জানায়, ১৫ জুলাইয়ের আন্দোলনবিরোধী পোস্ট ছাড়াও ১৬ জুলাইয়ের গণহত্যায়  শিক্ষক রাব্বানী  ছাত্রলীগকে পেছন থেকে সরাসরি ইন্ধন দিয়েছেন। এবং শহরের যুবলীগ‍‍`কে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া‍‍`র বাড়ি তার জেলায় হওয়ার কারণে এবং তিনি নীল দলের সাবেক সভাপতি হওয়ায় তাদের মধ্যে  গভীর রাজনৈতিক  সম্পর্ক ছিল বলে জানা গেছে।

সমগ্র বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর ড. মো ফেরদৌস রহমান বলেন, ছাত্র আন্দোলনে বিরোধিতা করলেও তো আমরা কোন অভিযোগ পাইনি তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ আসলে আমরা অবশ্যই তদন্ত কমিটি গঠন করে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব ।


বিআরইউ