সত্তর আশির দশকে ১২০০ সিনেমা হল নিয়ে সিনেমার বাজার চাঙা থাকলেও এই ২০২২ সাল চলচ্চিত্র জন্য কেটেছে নিরামিষ ভাবে! তিন ভাগ মন্দে আর এক ভাগ কেটেছে ভাল। মাঝপথে চাঙা হতে হতে ব্যর্থ হয়েছে বছর শেষে!
করোনার পর গেল কয়েক বছর বাণিজ্যিক সিনেমা এগুচ্ছে কচ্ছপ গতিতে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যখন পাশ্ববর্তী দেশগুলি বাণিজ্যিক সিনেমায় সফল গল্প আর পরপর হিটের তকমা দেখায়। তখন এদেশের শুধুমাত্র দুই ঈদ ছাড়া শেয়ার বাজারের মতো বাণিজ্যিক ছবির বাজার কাটে হতাশা আর ব্যার্থতায়! যদিও ভিন্নধারার গল্প তাদের টেনে নিয়েও পার পাচ্ছে না। এক কথায় একটি দুটি ছবিতো আর সারা বছরের ক্ষুধা মিটাবে না।
মৌলিক গল্প আর মূলধারার গল্পে দর্শক কিছুটা আশাবাদী হলেও বাণিজ্যিক গল্পে মূলত থাকে না গল্প, থাকে না নির্মাণ কৌশল আর না থাকে সাউন্ড-কালার কারেকশন। যেন পেপার কাটিং করে আর থুথু দিয়ে পোস্টার লাগানো গল্পের মতো। এতো বছর এই শিল্পের ব্যর্থতার পরও শিখতে চাইছে না কেউ! তাতেই যেন জং ধরছে গোটা চলচ্চিত্রে অঙ্গণে!
এতো কিছুর অবসান হতে পারে হয়তো সরকারি কোন সু-নজরে।
যদিও গেল বছর চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির মামলা-হামলা আর নির্বাচনের দিকে দর্শক নজর ছিল প্রখর। তারই ধারাবাহিকতায় পরপর দু থেকে চারটে সিনেমার বাজার ছিল চাঙ্গা আর তাই দিয়ে সুনাম বয়ে নিয়ে এসেছে বিশ্ব বাজার। জয় করেছিলেন দর্শক জনপ্রিয়তাও। এবারের তেমন খবরাখবর নিয়েই ‘দৈনিক আমার সংবাদ’ পাঠকদের জন্য আজকের আয়োজন।
এ বছর (২০২২) প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ৪৮টি সিনেমা। এরমধ্যে চঞ্চল চৌধুরী, সিয়াম, শাকিব খান এগিয়ে থাকলেও একাধিক নায়কের নিম্ন মানের অখাদ্য সিনেমাও মুক্তি পেতে দেখা গেছে। তবে ২০২২ এর সিনেমায় চঞ্চল চৌধুরী-সিয়াম-শাকিব খান এগিয়ে থাকলেও হতাশ করেছেন ইমন-নিরব-বাপ্পীরা।
নতুন বছরে নতুন অভিযোগ তেমন ভিন্ন খবর না হলেও এবারের বছর ভিন্ন খবরও পাওয়া যায়। শাপলা মিডিয়া নামক একটি প্রতিষ্ঠানের একাধিক ওয়েব সিরিজও সিনেমা আকারে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও সেগুলিও ব্যর্থতার মুখ দেখেছে।
এ বছরের মুক্তি পাওয়া ৪৮টি সিনেমার মধ্যে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলি হলো- ‘ছিটমহল’, ‘তোর মাঝেই আমার প্রেম’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ- ২’, ‘মাফিয়া- ১’, ‘মুখোশ’, ‘শিমু’, ‘গুণিন’, ‘লকডাউন লাভ স্টোরি’, ‘জাল ছেঁড়ার সময়’ মুক্তি পেলেও একসাথে রোজার ঈদে মুক্তি পায় ‘গলুই’,ও ‘শান’, ‘বিদ্রোহী’, ‘বড্ড ভালোবাসি’ এই চারটি ছবি।
এরপর ‘পাপ-পুণ্য’, ‘আগামীকাল’, ‘বিক্ষোভ’, ‘তালাশ’, ‘অমানুষ’, মুক্তি পায়। এরপর কোরবানির ঈদে ‘পরাণ’, আর ‘দিন- দ্যা ডে’, ‘সাইকো’ ছবি তিনটি মুক্তি পায়। এরপর মুক্তি পায় ‘কার্নিশ’, ‘যা হারিয়ে যায়’, ‘হাওয়া’, ‘আশীর্বাদ’, ‘ভাইয়ারে’, ‘লাইভ’,‘বীরত্ব’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘ঈশা খাঁ’, ‘হৃদিতা’, ‘যাও পাখি বলো তারে’, ‘রাগী’, ‘জীবন পাখি’, ‘বসন্ত বিকেল’, ‘রোহিঙ্গা’, ‘দামাল’, ‘কুড়া পক্ষীর ন্যে উড়া’, ‘দেশান্তর’, ‘ভাঙন’, ‘মেইড ইন চিটাগং’, ‘ও মাই লাভ’, ‘হডসনের বন্দুক’, ‘জয় বাংলা’, ‘৭১ এর একখন্ড ইতিহাস’, ‘পায়ের ছাপ’ ও শেষ মুক্তি পাওয়া ‘কাগজ’ ছবিটি।
২০২২ এর শুরুতেই ‘ছিটমহল’, আর ‘তোর মাঝেই আমার প্রেম’ এর মতো ছবি দিয়ে হতাশার বছর শুরু হলেও পরিচালক দেবাষিশ বিশ্বাসের আলোচিত ছবি আর এই পরিচালকের প্রথম খন্ড ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ সুপারহিট দিবার পর ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ- ২’ এ নায়ক বাপ্পী আর নায়িকা অপু বিশ্বাস দর্শকের মনে তেমন জায়গা করে নিতে পারেনি। যাও দর্শক পেয়েছিল তাও ছিল এই পরিচালকের নির্মাণ কৌশলীতে। এরপর ‘মাফিয়া- ১’, ‘মুখোশ’, ‘শিমু’, ‘গুণিন’, ‘লকডাউন লাভ স্টোরি’, ‘জাল ছেঁড়ার সময়’ এসব ছবি টানা সিরিজ ফ্লপ দিবার পর রোজার ঈদে শাকিব খানের ভক্তদের ‘গলুই’ দিয়ে হল এ ফিরতে দেখা যায়। এই মৌলিক গল্পের আর সরকারী অনুদানের ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন পরিচালক এস এ হক অলিক।
ঈদে শাকিব খানের ছবির সাথে পাল্লা দিয়ে নায়ক সিয়ামের ‘শান’ ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটি মফস্বল-শহরে তেমন প্রভাব খাটাতে না পারলেও ঢাকার সিনেপ্লেক্স ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতোই। অনেকের মতে ঈদের ছবি দুটি বেশ দর্শক টানলেও সিনেমার মূলধন ফিরাতে পারেনি বলেও চলচ্চিত্র পাড়ায় গুঞ্জন শোনা যায়। তবে প্রযোজকদের ভাষ্য মতে তারা হতাশ হননি। তবে বাকি ছবি ‘বিদ্রোহী’তে শাকিব খান থাকায় কিছুটা দর্শক টানলেও ‘বড্ড ভালোবাসি’ হয়েছিল সুপার ফ্লপ। যা শেষ পর্যন্ত পোস্টারের টাকাও ফেরত পায়নি ছবিটি।
এরপর আবার টানা ফ্লপ ছবির জোয়ার শুরু হয়। এরমধ্যে ‘পাপ-পুণ্য’, ‘আগামীকাল’, ‘বিক্ষোভ’, ‘তালাশ’, ‘অমানুষ’ ছবিগুলি মুক্তি পায়। যদিও ‘পাপ-পুণ্য’ এ নায়ক সিয়াম থাকা সত্ত্বেও ফ্লপ হয় আর ‘আগামীকাল’ ছবিতে তিন জন দর্শকের কথা শোনা যায়। ‘বিক্ষোভ’, ‘তালাশ’ এ মুখ থুবরে পড়লে হতাশ হতে দেখা যায় নায়ক নিরবের ‘অমানুষ’ ছবিটিতে। যদিও এই ছবিতে নতুন মুখ আর অভিনেতা মিশা সওদাগর থাকার পরও তেমন ব্যবসা করতে পারেনি ছবিটি।
কোরবানির ঈদে ‘পরাণ’, আর ‘দিন- দ্যা ডে’, বেশ আলোচনায় আসলেও মধ্যে দর্শক চাহিদার তলানীতে নায়ক রোশানের ‘সাইকো’কে। অনন্ত জলিলের ‘দিন- দ্যা ডে’ ৪ কোটির সিনেমা ১০০ কোটি বলে চালিয়ে আর মার্কেটিং এ ১৬ লক্ষ টাকা খরচ করে বেশ আলোচনায় থাকতে দেখা যায় এই সিনেমাকে। যদিও শেষ পর্যন্ত তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তবে সেই সুযোগে ওই সিনেমাকে
টপকিয়ে লাইভ টেকনোলজির প্রযোজনায় ‘পরাণ’ ব্যবসায়িকভাবে ব্যপক হিটের তকমা পেতে দেখা যায়। তবে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের যাদুকরি তকমা আর মার্কেটিং এ পরিচালককে শেষ পর্যন্ত আর পাশে দেখা যায়নি। কারণ এরপর চ্যানেল আই এর প্রযোজনায় তার পরের ছবিটি ব্যর্থ হিসেবে বিবেচিত হয় এই পরিচালকের।
এরপর ‘কার্নিশ’, আর ‘যা হারিয়ে যায়’ মুক্তি পেলেও ঈদের পরপর চঞ্চল চৌধুরীর ‘হাওয়া’ সকল ছবিকে টপকিয়ে এ বছরের সেরা ছবিতে চলে আসে। রূপান্তিত হয় এই বছরে শ্রেষ্ঠ সিনেমায়। যার গান ‘সাদা সাদা কালো কালো’ নিমেষেই ভাইরাল হয়ে যায়। এমনকি মুক্তির দিন টিকিট নিয়ে মারামারিও করতে দেখা যায়। টানা তিনমাস চলার পর দেশ ও দেশের বাইরে থেকে সুনাম বয়ে আনতে থাকে ছবিটি।
এরপর আবার শুরু হয় টানা সিরিজ ফ্লপের কিত্তি খেলা। ‘আশীর্বাদ’, থেকে শুরু করে ‘ভাইয়ারে’, এরপর ‘লাইভ’,‘বীরত্ব’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘ঈশা খাঁ’, ‘হৃদিতা’, ‘যাও পাখি বলো তারে’, ‘রাগী’, ‘জীবন পাখি’, ‘বসন্ত বিকেল’, ‘রোহিঙ্গা’, ‘দামাল’, ‘কুড়া পক্ষীর ন্যে উড়া’, ‘দেশান্তর’, ‘ভাঙন’, ‘মেইড ইন চিটাগং’, ‘ও মাই লাভ’, ‘হডসনের বন্দুক’, ‘জয় বাংলা’, ‘৭১ এর একখন্ড ইতিহাস’, ‘পায়ের ছাপ’ ও শেষ মুক্তি পাওয়া ‘কাগজ’ ছবিগুলি। এই পরের ছবিগুলি দর্শকদের তেমন আর হল এ ফিরাতে পারেনি। যদিও শেষ ভরসা হিসেবে নায়ক বাপ্পী`র অভিনীত একটি সরকারী অনুদানের ছবি মুক্তি পেলে তার মুখ থুবড়ে পড়তে দেখা যায় আর দর্শক চাহিদার তলানিতেও দেখা যায় ছবিটি।
এই ভালো মন্দের নিরামিষ বছর শেষ হলেও ২০২৩ এর বছরটা কেমন কাটবে সেই চিন্তায় দিন গুনছে চলচ্চিত্রের পরিচালক আর প্রযোজকরা। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শাকিব খানের ‘শিকারী’ সিনেমার পর ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’ একটা নতুন ধামাকা দেখাবে বলে একটি বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে।