শনিবার (১৮ নভেম্বর) বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা “নারী মৈত্রী”র আয়োজনে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয় ।
নারী মৈত্রীর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আকতার ডলি এর সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব হোসেন আলী খোন্দকার, সমন্বয়কারী (অতিরিক্ত সচিব), জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি)।
এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, শাহ শেখ মজলিশ ফুয়াদ, পরিচালক (অধ্যায়ন ও প্রশিক্ষণ), প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি), তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, শ্যামল দত্ত সম্পাদক, দৈনিক ভোরের কাগজ , সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব , প্রথম আলোর যুগ্ম–সম্পাদক জনাব সোহরাব হাসান, জনাব রাশেদ রাব্বি, সভাপতি, হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম, জনাব প্রনব সাহা, সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ ,জনাব রিয়াজ আহমদ নির্বাহী সম্পাদক, ঢাকা ট্রিবিউন, জনাব জুলহাস আলম, ঢাকা ব্যুরো প্রধান, নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ,এসোসিয়েটেড প্রেস এবং ব্যবস্থাপনা কমিটি সদস্য, জাতীয় প্রেস ক্লাব , লোটন একরাম, প্রধান প্রতিবেদক, দৈনিক সমকাল, এবং শাহনাজ বেগম পলি সদস্য, ব্যবস্থাপনা কমিটি, জাতীয় প্রেস ক্লাব।
অনুষ্ঠানে বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- মো. আব্দুস সালাম মিয়া, প্রোগ্রামস ম্যানেজার, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস বাংলাদেশ,অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাছরিন আকতার, প্রোজেক্ট কোঅর্ডিনেটর, নারী মৈত্রী।
শাহীন আকতার ডলি বলেন, বর্তমানে তরুণরা ই-সিগারেট এর প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে পরছে। তাদের এই আসক্তি থেকে বের করে আনতে ই-সিগারেট বাজারজাত বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরী। শুধু তাই নয় বন্ধ করতে হবে সিগারেট এর খুচরা শলাকা বিক্রি। ,পাশাপাশি তামাকজাত পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর আকার ৫০% থেকে ৯০% এ বৃদ্ধি করা এবং বিক্রয় স্থানে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে।
আব্দুস সালাম মিয়া বলেন, তামাক একটি প্রাণঘাতী দ্রব্য। তামাকের পক্ষে বলার মতো একটি শব্দও নেই। তামাক পরিবেশ, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। টোব্যাকো এটলাস ২০১৮- এর তথ্য মতে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মানে প্রতিদিন ৪৪২ জন মানুষ প্রাণ হারান । জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় ও জীবন রক্ষায় দ্রুততম সময়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করতে হবে এখনই। আইন শক্তিশালী করবার এই পদক্ষেপ বেগবান করতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে পারেন আমাদের গণমাধ্যমের বন্ধুগণ,যাদের সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের লেখনি ও গণমাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের কাছে পৌছানোর কৌশল।
আর একটি প্রানও যাতে না হারাতে হয় তামাকের কারনে সে প্রেক্ষাপটে সোহরাব হাসান বলেন, প্রতিদিন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন এই ভয়ঙ্কর তামাকের আগ্রাসনে। তামাকের এই সর্বগ্রাসী আগ্রাসন ও তামাক মহামারী আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। আমাদের তামাকের ভয়াবহতা সম্পর্কে আরও সোচ্চার হতে হবে ।পাশাপাশি তামাক কোম্পানির গুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করতে হবে।
হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম এর সভাপতি, জনাব রাশেদ রাব্বি বলেন, তামাক জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। শ্বাসকষ্ট , ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ নানান রকম জটিল রোগের সৃষ্টি হয় তামাক সেবনের কারনে। তামাক সেবন না করেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে অধূমপায়ীরা। তাই জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে সকল ধরনের ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করা উচিৎ। সেক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রন আইন শক্তিশালী করা খুব দ্রুত প্রয়োজন।
নারী মৈত্রীর তামাক নিয়ন্ত্রণ সকল ধরনের কার্যক্রমে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে প্রনব সাহা বলেন, তামাক অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে শুধু অবগত হলেই চলবেনা, যার যার অবস্থান থেকে আইন শক্ত অবস্থান নিতে হবে যাতে করে আইন শক্তিশালীকরণের পদক্ষেপ বেগবান হয় । এই ধরনের চমৎকার উদ্যোগের জন্য নারী মৈত্রীকে তিনি ধন্যবাদ জানান ।
রিয়াজ আহমদ বলেন, নারী মৈত্রীর এমন উদ্যোগ প্রশংসনীয়। জাতীয় স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে পাশ হয়ে আসে সেজন্য সংশোধনের পক্ষে ইতিবাচক তথ্য ও প্রচারণা সাংবাদিক বন্ধুদের স্ব-স্ব মিডিয়ার মাধ্যমে তুলে ধরবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তামাক কোম্পানিগুলো নানামুখী অপ-কৌশলে বিভ্রান্ত না হওয়ার কথা জানান জুলহাস আলম, তিনি বলেন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের অধিকতর সংশোধনী আনার যে উদ্যোগ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে একটি সময়োচিত এবং জনবান্ধব উদ্যোগ। তবে বেশ কিছু ধাপ পার হলেও আইনটিকে চূড়ান্ত রূপ পেতে হলে আরো কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে। এখনও এটি পাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এটিকে আইনে রূপান্তরের পথে নানা রকম বাধা আসার আশঙ্কা রয়েছে, বিশেষ করে সংশোধনীর বিপক্ষে তামাক কোম্পানিগুলো নানামুখী অপ-কৌশল ও অপ-তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা নানা রকম বিভ্রান্তিমূলক তথ্য মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করে জনবিভ্রান্তি তৈরি করছে। এক্ষেত্রে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদেরকে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে।
লোটন একরাম বলেন, তামাকের ভয়াল ছোবল থেকে আমাদের সন্তান এবং প্রিয়জনকে রক্ষা করতে সিগারেট এর খুচরা বিক্রি বন্ধ করা সত্যিই প্রয়োজন, সেই সাথে প্রয়োজন এর দাম বাড়িয়ে এমন যায়গায় নিয়ে যাওয়া যাতে আমাদের সন্তানসহ সকলের নাগালের বাইরে চলে যায়। এ জন্য আমাদেরকে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
শাহনাজ বেগম পলি তার বক্তব্যে তুলে ধরেন, বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক অন টোব্যাকো কন্ট্রোল-এফসিটিসি’তে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশ। তামাকের মহামারী সম্পর্কিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ধুমপানমুক্ত পরিবেশ এবং তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রণোদনা নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে এখনও সর্বোত্তম মান অর্জন করতে পারেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত প্রস্তাবিত সংশোধনীটি পাশ হলে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের দুর্বলতাগুলো দূর হবে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি’র সুপারিশসমূহের কার্যকর বাস্তবায়ন এবং বৈশ্বিক সর্বোৎকৃষ্ট অনুশীলনের আলোকে বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি বৈশ্বিক মানদন্ডে উপনীত হবে।
নারী স্বাস্থ্যের কথায় জোর দিয়ে শ্যামল দত্ত বলেন ধূমপান শুধু ব্যবহারকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে না, উপরন্তু যারা তাদের আসে পাশে থাকে তারাও এর ক্ষতির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। বিশেষভাবে শিশু, নারী ও নারীর গর্ভের সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সকল পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও গণপরিবহণে ধূমপানের জন্য নিধারিত স্থান নিষিদ্ধ করতে হবে।
প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এর পরিচালক ( অধ্যায়ন ও প্রশিক্ষণ), জনাব শাহ শেখ মজলিশ ফুয়াদ বলেন তামাকের কারনে সৃষ্ট রোগ ও মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য, এবং সেটি তখনই সম্ভব যদি বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করা হয়। তাই আমাদের সকলের একটাই দাবি আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করা হোক।
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি) এর সমন্বয়কারী (অতিরিক্ত সচিব), জনাব হোসেন আলী খোন্দকার, তামাকের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি বিষয়ে সাধারণ মানুষকে অবহিত করতে হবে। তামাক থেকে সরকারের যে রাজস্ব আয় আসে তার চেয়ে তামাক ব্যবহারজনিত কারনে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা বাবদ ব্যয় ২৭% বেশী। রাজস্ব আয় প্রায় ২২ হাজার ৮১০ কোটি এবং চিকিৎসা ব্যায় প্রায় ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। তামাকের কারণে বার্ষিক ক্ষতি প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা (ক্যান্সার সার্ভে-২০১৮)। সুতরাং মানুষের ভ্রান্ত ধারণা দূর করার পাশাপাশি প্রয়োজন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করা । তামাকের বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে নিজ অবস্থান থেকে হতে হবে সচেতন।
সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো, সমকাল, ইত্তেফাক, ঢাকা ট্রিবিউন, যমুনা টেলিভিশন, জনকন্ঠসহ বিভিন্ন মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের গনমাধ্যম কর্মীবৃন্দ।
আরএস