খাবার স্যালাইনের উদ্ভাবক ড. দিলীপ মারা গেছেন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২২, ১২:৩৯ পিএম
খাবার স্যালাইনের উদ্ভাবক ড. দিলীপ মারা গেছেন

যার তৈরি করা ফর্মুলায় আজ পর্যন্ত কোটি কোটি শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশে ঘরে ঘরে বহুলপ্রচলিত ওআরএসের (খাওয়ার স্যালাইন) উদ্ভাবক ড. দিলীপ মহলানবিশ মারা গেছেন।

রোববার (১৬ অক্টোবর) সকালে কলকাতার একটি হাসপাতালে ৮৮ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। মূলত বার্ধক্যজনিত কারণেই তিনি মারা গিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে ৷

একাত্তরের যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে থাবা বসিয়েছিল কলেরা। শিকড়-ছেঁড়া লাখ লাখ মানুষ অস্থায়ী শিবিরে আক্রান্ত হতে লাগল কলেরায়। ক্রমশ মহামারি। গ্রামের পর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ। ভয়ঙ্কর সেই মৃত্যুর মিছিলে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছিলেন তিনি।

ওআরএসের প্রথম ব্যবহারিক প্রয়োগটি তিনি শুরু করেন একাত্তরে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া লাখ লাখ শরণার্থী শিবিরে চিকিৎসা করতে গিয়েই। 

সে সময় রোগীদের ধমনীতে সূঁচ ফুটিয়ে স্যালাইন দেয়ার রীতি ছিল, কিন্তু তিনি প্রথম লবণ, চিনি ও বেকিং সোডার মিশ্রণ পানীয় আকারে খাওয়ানোর প্রথা শুরু করেন। যা পরবর্তী পাঁচ দশকে এশিয়া, আফ্রিকায় এমন কী উন্নত বিশ্বেও অগুনতি মানুষের জীবন রক্ষা করেছে।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁর একটি রিফিউজি ক্যাম্পে মেডিকেল সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ দিলীপ মহলানবিশ।

সেখানকার বাংলাদেশি শরণার্থী শিবিরগুলোতে এই ওআরএস এক জীবনদায়ী ম্যাজিকাল ফর্মুলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। তখনও কিন্তু ওআরএস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতিই পায়নি, ফলে দিলীপ মহলানবিশ কিছুটা ঝুঁকি নয়েই এ কাজ শুরু করেছিলেন। কলেরায় আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষকে তিনি সারিয়ে তুলেছিলেন এই ওআরএস দিয়েই।

প্রচারবিমুখ দিলীপ মহলানবিশ তার এ অসাধারণ উদ্ভাবনের জন্য কোনও পেটেন্ট নেননি, তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তাকে এই কাজের সব রকম স্বীকৃতি দিয়েছে।

কলকাতার বিশিষ্ট শিশু চিকিৎসক দ্বৈপায়ন ঘটক ড. দিলীপ মহলানবিশের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘ওআরএসের জন্য আপনি কেন কোনোদিন পেটেন্ট নিতে চাননি?’ উত্তরে মহলানবিশ বলেছিলেন, ‘ওআরএস যে শিশুদের প্রাণ বাঁচাচ্ছে তাদের মুখের হাসিটাই তো আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। আমি পেটেন্ট দিয়ে কী করব?’

১৯৯০ সালে তাকে ঢাকার বিখ্যাত আইসিডিডিআরবি’র ক্লিনিক্যাল গবেষণা কর্মকর্তা করে পাঠানো হয়, বেশ কয়েক বছর তিনি দক্ষতার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

তিনি জন্মেছিলেন অবিভক্ত বাংলার কিশোরগঞ্জে। দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। প্রথমে বরাহনগর, পরে শ্রীরামপুর। কাজের জন্য অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মান পেয়েছেন। 

১৯৯১ সালে সল্টলেকে নিজের বাড়িতে ‘সোসাইটি ফর অ্যাপ্লায়েড স্টাডিজ’ তৈরি করেন— ডাক্তারি পাস করা ছেলেমেয়েদের হাতেকলমে গবেষণা এবং ফিল্ডওয়ার্ক শেখানোর উদ্যোগ। 

ঠিক যেভাবে তিনি চিকিৎসক হিসেবে তার জীবন শুরু করেছিলেন, সেভাবেই ছাত্র-ছাত্রীদের ডাক্তারি শেখাতে চেয়েছিলেন তিনি।

১৯৬০-এ লন্ডনে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস চালু হতে প্রচুর ডাক্তারের চাহিদা তৈরি হয়। দিলীপ মহলানবিশ আবেদন করতেই সুযোগ পান। এর পর লন্ডনে ডিসিএইচ করেন। 

এডিনবরা থেকে এমআরসিপিও। তার পর কুইন এলিজাবেথ হসপিটাল ফর চিল্ড্রেন-এ রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেন এই বাঙালি চিকিৎসক। তখন তার বয়স তখন মাত্র ২৮। ওই পদে তিনিই প্রথম ভারতীয়।

এরপর আমেরিকায় জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির মেডিকেল কেয়ার ফেলো পদে যোগ দেন দিলীপ। তখন ওই প্রতিষ্ঠানের একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র ছিল বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালে। কলেরা আক্রান্তদের চিকিৎসা হতো সেখানে।

১৯৬৪-তে দেশে ফিরে দিলীপ সেখানে যোগ দেন। শুরু করেন ওআরএস এবং স্পেশাল মেটাবলিক স্টাডি নিয়ে গবেষণার কাজ। হাতেকলমে সাফল্য পেলেও গবেষণাপত্র বার করা হয়ে ওঠেনি। তার পরেই ঘটে ১৯৭১ সালের ওই ঘটনা।

১৯৭৩-এ জন হপকিনস মেডিকেল জার্নালে তা প্রকাশিত হয়। পরে ‘ল্যানসেট’ পত্রিকাও স্বীকৃতি দেয় ওই গবেষণালব্ধ পর্যবেক্ষণকে। কলেরা কিংবা ডায়রিয়ার চিকিৎসায় বিশ্বে স্বীকৃতি পায় ওআরএস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ সসন্মানে ডেকে নেয় তাকে। সূত্র: আনন্দবাজার, হিন্দুস্তান টাইমস

টিএইচ