এই যে শুনছেন ? জ্যাকেটের পকেট থেকে হাতদুটি বের করতে করতে মৃদুলের জবাব, আমাকে বলছেন ? হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। আপনিতো খুব সুন্দর ছবি আঁকেন! এক্সকুয়িজ মি,আমি ছবি আঁকিনা। শুধু মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠা প্রকৃতির দৃশ্যগুলোকে রংতুলির একটু আছড় দেই। বাহ,আপনার কথাগুলো যেনো এক একটা কাব্য।আমি নীরা আপনি?
জি,আমি মৃদুল। প্রদর্শণীর কয়েকটি পেইন্টিং ছিলো অসাধারণ,বুঝতে পারছিলাম না এগুলো কার আঁকা। অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে শিল্পীকে চিনতে।অথচ,এখন সেই ছবির জীবন্ত কারিগর আমার সামনে দাঁড়িয়ে! আপনাকে বড্ড ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে বলে অট্টহাসিতে ফেটে পরেন নীরা। হাসির শব্দ শুনে মনে হচ্ছে শান বাঁধানো কোনো শান্ত দীঘির জলে স্বাধীনচেতা রাজহাঁসের দল ডানা ঝাপটাচ্ছে,আর সেই ডানার আলতো স্পর্শ প্রতিধ্বণি হয়ে মৃদুলের বুকে ধাক্কা খাচ্ছে। আচ্ছা,আপনি কি সব সময় এরকমই গম্ভীর থাকেন? জি, উত্তরে মৃদুল।
চায়ের কাপে আলতো চুমুক,আঙুলের ফাঁকে থাকা সিগারেট পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হওয়ার উপক্রম, রূপোলি চাঁদের আলো বাসন্তি রঙ ধারণ করে টিকরে বেরুচ্ছে জোঁছনা হয়ে। পাশের বিল্ডিংয়ের আনোয়ার মিয়ার ছাঁদবাগান থেকে ভেসে আসছে হাসনাহেনার মৌ মৌ গন্ধ। প্রকৃতির অপূর্ব এ কেমেস্ট্রিতে মাতোয়ারা মৃদুল।
ছাঁদের রেলিংয়ের ওপর পা রেখে নতুন পেন্টিংয়ের প্লানিংয়ে হারিয়ে যায় ভাবনার অতলে। টুং করে আওয়াজ আসে মৃদুলের ভেরিফায়েড ফেসবুক থেকে।জোছঁনা রাতে ``শাদা জোঁছনা” নামের আইডির কী অদ্ভুদ মিল, ভেবে হাসি পায় তার।আইডির টাইমলাইন চেক করতে গিয়ে থ হয়ে যায় সে। এক্সিভিশনে তার আঁকা পেইন্টিংয়ের ছবি আপলোড করা। সে ছবিতে দেখা যায় নীরা নামের মেয়েটিকে।
সকাল দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট, তরিঘড়ি করে বের হয়ে যায় মৃদুল।অফিসে বসের সাথে দেখা করে যেতে হবে গ্যালারীতে। গরম কফিতে দু চুমুক দিয়েই ছুটে চলা। প্রাইভেট জব করে মৃদুল,প্রকৃতি পাগল এ যুবকের প্রকৃতি নিয়েই যত ভাবনা। আর তাই শখের বশে সেগুলোকে সাদা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলে।
দেখতে সুদর্শন উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের, পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট টগবগে এক তরুণ, সবসময় নিজের পছন্দের জিনিস ব্যবহার করা তার পুরনো স্বভাব। যে কোনো নারী প্রথম দেখাতেই আকৃষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো। অ্যাশ কালার টি শার্ট,স্কাই ব্লু জিন্স, নেভী ব্লু কেডস আর প্রিয় পারফিউম মেখে নেয় দ্রুত। কালো সানগ্লাসটা লাগিয়ে সাঁ সাঁ করে বাইকে ছুটে যায়। ছোট বেলা থেকে মৌন আর নিভৃতচারী স্বভাবের মৃদুলের একাকিত্বই যেন সঙ্গী।
শাহবাজপুর শিল্পকলা একাডেমিতে এক্সিভিউশনে পুরো হল ভর্তি লোকজনে ঠাসা। মাঝে মাঝে ভেসে আসে দামি পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ। হলরুমের ভীড় ঠেলে দর্শনার্থীদের মতই পেইন্টিংয়ে চোখ ভোলাচ্ছেন মৃদুল। হঠাৎ নীরা নামের মেয়েটি সামনে এসে হাজির। তার নানা প্রশ্ন,মৃদুল আপনি কি সবসময় এভাবেই থাকেন,না কি সুন্দরী মেয়ে দেখলে ভাবে থাকেন?
জবাব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে কর্ণারের কফি শপে চলে যায় মৃদুল।পিছন পিছন মেয়েটির আগমন, আমি কি সামনের চেয়ারটায় বসতে পারি? হ্যাঁ বসেন।আচ্ছা আপনি কি হাসতে জানেন না? তখনই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি মৃদুলের।মৃদুলের মৃদু হাসিতে অসম্ভব ভালো লাগার পরশ বুলিয়ে যায় নীরার হৃদয় গহীণে।
আড়চোখে তাকায় মৃদুল,মনে মনে ভাবে মেয়েটির আর যা ই হোক চোঁখগুলো উজ্জ্বল ছলছলে মায়াবী হরিণীর মত। কফির মগ নিতে গিয়ে দুজনের হাতে আলতো স্পর্শ,লজ্জায় হাত সরিয়ে নেয় মৃদুল। আবারো প্রশ্নবাণে কুপোকাত করে নীরা। আপনি এত প্রতিভাবান মানুষ, নিজেকে লুকিয়ে রাখেন কেনো?
জবাব নেই মৃদুলের।নীরা ও নাছোরবান্দা,আপনি ইনবক্সে রিপ্লাই দেন না কেন? রিপ্লাই দেবেন আশা করি,জরুরী কথা আছে। মৃদুল ভাবে আচ্ছা বজ্জাত মেয়েতো, আমাকে কমান্ড করছে! মুখে মাস্ক লাগিয়ে কপালে ছড়িয়ে থাকা সোনালি রংয়ের এলোমেলো চুলগুলোকে সরিয়ে নিয়ে হঠাৎ ছিটকে পরা মেয়েটির চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে আর হাসে মৃদুল।
রাতে টুং করে নটিফিকেশন,কেমন আছেন?জবাব নেই কেনো? মৃদুলের জবাব,ভালো। আচ্ছা,আমার একটা কথা রাখবেন? জি,বলেন। আমার একটি ছবি একেঁ দিবেন,জলরং দিয়ে?মৃদুল এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেননা,গম্ভীর হয়ে যায় সে। কারো ছবি আঁকার কথা শুনলে বুকের ভিতর ধক করে ওঠে মৃদুলের। তাঁর যে ছবি আঁকা বারণ।ছোটবেলায় একবার ছবি একেঁছিলো মৃদুল।
ছেলের ছবি আঁকা দেখে মা জাহানারা বেগম খুব খুশি হয়েছিলেন ঠিকই,তবে তার অনুরোধ ছিলো, তুই আর কোনোদিন মানুষের ছবি আঁকবি না।মাকে প্রতিশ্রুতি দেয় সে,আমি আর কোনোদিন ছবি আঁকবনা। প্রিয় শখকে আজ জলাঞ্জলি দেয় মৃদুল। বুকের গহীণে দাফন করে দেয় ছবির প্রতি অগাধ ভালবাসাকে। হ্যাঁ, বাবা তুইও মন খারাপ করিসনা। অবশ্যই ছবি আঁকবি, তবে তা যেন হয় প্রকৃতিকে নিয়ে।
ম্যাসেজের টুংটাং শব্দে মগ্নতা কেটে যায় মৃদুলের। নীরা`র প্রশ্ন কি ব্যাপার শিল্পী সাহেব,আমাকে দেবেন না একটি ছবি এঁকে? মৃদুলের রাগান্বিত জবাব, না। আমি ছবি আঁকতে পারিনা,আপনাকে কে বলল আমি ছবি আঁকি? মোবাইলের ডাটা অফ করে ঘুমিয়ে পরে সে।
মাঝরাতে নটিফিকেশনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় মৃদুলের। ‘মৃদুল` আমি জানিনা আপনি কেন এমনটা করলেন?নীরা তার লজীবনের গল্প শেয়ার করে।
জানেন, এক সপ্তাহ আগে আমার বাবা মারা যায়। প্রতিরাতে বাবার মুখচ্ছবি দেখতে পাই। আমি ছিলাম বাবার খুব আদরের। বাসায় মা আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। এক সময় খুব আনন্দ,উচ্ছলতায় পুরো ঘর মাতানো থাকত। সন্ধ্যেবেলা মুখিয়ে থাকতাম বাবা কখন আসবে। প্রিয় জিনিসগুলো নিয়ে মায়ামাখা হাসি দিয়ে কাছে ডাকতেন বাবা। আজ তিনি নেই,আমাদের একা করে দিয়ে চলে গেছেন তার স্থায়ী নিবাসে। এখন আমার প্রতিটি রাত কাটে একাকীত্বের সঙ্গে।
বান্ধবীরা বলেন, নিজেকে একটু আনন্দের মধ্যে রাখ, দেখবি মন ভালো হয়ে যাবে। কারো সাথে মিশতে ইচ্ছে করেনা। কেন জানি আপনাকে খুব আপন মনে হলো,তাই বললাম। জলরংয়ের ছবির প্রতি শখ থাকায় ইচ্ছেটা পোষণ করলামমাত্র। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত’ লম্বা ম্যসেজটি পড়ে মৃদুলের মন খারাপ হয়ে গেল। অনুশোচনায় ভুগছেন আর ভাবছেন এত রাতে আর লিখব না।
পরদিন সন্ধ্যায় রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা শিল্পকলার উদ্দেশ্যে মৃদুল। হঠাৎ রাস্তায় আবছা কোনো নারীমূর্তির অভয়াভব চোখে পরে তার,সজোড়ে হাইড্রোলিক ব্রেক কষে নেয় । এলোমেলো বাতাসে দোলখাওয়া সোনালি চুলে বাসন্তি রঙের শাড়ী পরিহিত নীরা নামের মেয়েটি দৃশ্যমান হয়। ছিমছাম ফর্সা রঙের মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন স্বর্গের কোনো অস্পরী।
চোখের চাহনীতে অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি জানান দেয়।ডিপ্রেশনে থাকতে থাকতে চোখের নিচের কালচে দাগগুলো স্পষ্ট। তবে ফর্সা মুখে কালো কয়েকটি তিল সৌন্দর্য্যের বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। ভীষণ গম্ভীর মুখ আর কাপা কাপা ঠোঁট দেখে সহজে বুজা যায় হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা কথাগুলো প্রকাশ করতে চায় এ তরুণী। বাইক থেকে নেমে ছোট্ট করে সরি বলে অমিত।
এ সরির মাঝে প্রকাশ পায় অনুশোচনার দীপ্তি। ছলছল করে ওঠে নীরার চোঁখদুটি। তোমায় অনেক ভালবাসি বলেই জড়িয়ে ধরে মৃদুলকে। তুমি আমায় কখনো ছেড়ে যাবেনাতো বলে নীরা। মৃদুল, লম্বা নিঃশ্বাস টেনে হাতদুটো প্রসারিত করে শক্ত করে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় নীরাকে। জনমানবহীণ সর্পিলাকার পিচঢালা পথে মৃদুল-নীরার ভালবাসার স্বাক্ষী হয়ে থাকে উজ্জ্বল শাদা জোঁছনা।
এক্সিভিশনের শেষ দিন আজ। হলরুমের চারদিকটায় হন্যে হয়ে মৃদুলকে খুঁজছে নীরা, কোথাও নেই। ভীষন্ন মন নিয়ে কফি শপের কোণে বসে থাকে প্রিয়জনের অপেক্ষায়। হঠাৎ কারো শীতল স্পর্শে কেপে ওঠে নীরা’র সোনালি রঙের ব্লাউজের ফাঁকে থাকা খালি পিঠ। পেছনে ফিরে বড় একটা প্যাকেট হাতে মৃদুলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ দুটো টলটল করতে থাকে নীরা`র। এটা তোমার জন্য,বলে মৃদুল। এটা কি পেইন্টিং?
জানতে চায় নীরা।বাসায় গিয়ে দেখো। না ,আমি এখনই দেখবো। কী জেদী মেয়েরে বাবা,বলে মৃদুল। ঝকঝকে গিফট পেপারে মোড়ানো প্যাকেট খুলে থ বনে যায় নীরা। আরে এটাতো আমারই ছবি!উচ্ছাস যেনো থামছেইনা তার,লাভ ইউ বলে জড়িয়ে ধরে মৃদুলকে।
সাগড় পাড়ের উদ্দ্যেশ্যে ছুটে যায় তাঁরা,কত জল্পনা-কল্পনা!যেনো,সুদীর্ঘ মৌনতার অবসান ঘটিয়ে এক পশলা প্রশান্তি হয়ে নীরা আসে মৃদুলের জীবনে। বাকী জীবন একসাথে থাকার স্বপ্নবু্নণের স্টোন গেঁথে যায় বারবার। প্রবল এই ভালবাসার আকুতি দেখে মিটিমিটি হাসে রূপোলি জোঁছনারা।
দিনের আলো ক্রমেই সরে গিয়ে সন্ধ্যাকে আহবান করে যায়। একপাশে নীল জলবেষ্টিত সমুদ্র অন্যপাশে গাঢ় সবুজে আচ্ছাদিত সুউচ্চ পাহাড়,হোটেল লবিতে শোভা পায় নিয়ন আলো। মাঝে মাঝে দেখা মিলে, আকাশের পানে ছুটে চলা গাঢ় গোলাপি রঙের ফানুসদের। দৃশ্যগুলো দারুণ উপভোগ করছে মৃদুল-নীরা।
মেরিন ড্রাইভের পথ ধরে তাদের বাইক ছুটে চলে ইনাণীর উদ্যেশ্যে। উচ্ছসিত মৃদুলের বাইক প্রবল গতিতে ছুটে চলে কুয়াশাভেজা পিচঢালা পথ ধরে। অট্টহাসিতে নীরা বলে আস্তে চালাওনা! সরু রাস্তায় মোড় থাকতে পারে মৃদুলের খেয়াল ছিলোনা। বেখেয়ালি মৃদুল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিটকে যায় রাস্তার বাহিরে। সমুদ্রের তীরবর্তী ব্লকের সাথে সজোড়ে ধাক্কা খায়।
জ্ঞান ফিরে রাতে নিজেকে আবিস্কার করে হসপিটালের বেডে। আবছা আবছা দেখতে পায় মৃদুল। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা,রক্ত বেয়ে গালের পাশ ছুঁয়ে হাতের আঙুলের মাথায় এসে জমাট বেধে গিয়েছে। সামনে আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা শাদা শার্ট,টাই পরিহিত লোকটিকে দেখতে পেয়ে ভড়কে যায় মৃদুল।
আলতো আঙুলের ইশারায় খোঁজতে থাকে নীরাকে। পাশের বেডে থাকা নীরা, শাদা শার্ট পরিহিত অলি আহমেদ মামুন কে জিজ্ঞেস করে, রক্তাক্ত এ লোকটি কে? আমাদের কেবিনে কেনো? কি হয়েছে ওনার?নীরা`র প্রশ্ন শুনে মামুন সাহেবের দিকে কাপাকাপা হাতের ইশারায় কী যেনো বলতে চায় মৃদুল। মামুন সাহেব বলেন, নীরা আমার বাগদত্তা।
দীর্ঘদিন সে ডিমেনশিয়া রোগে ভুগতেছিলো। আপনার সাথে মিশে যেন নতুন প্রাণের অস্তিত্ত্ব খুজে পায়।একথা শুনেই মাথার ব্যাথাটা যেনো আরো তীব্র হয়ে ওঠে মৃদুলের। নিজেকে সামলিয়ে মৃদু হেসে যায় সে,চোঁখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে গাল বেয়ে পরে।মৃদু হাসি দেখেই চিৎকার করে ওঠে নীরা।
এ হাসি যে তার খুব চেনা, কেন মনে আসছেনা!শার্টের কলার ঝাপটিয়ে ধরে মামুন সাহেবকে বলতে থাকে, বল! কে উনি ? আমার কাছে ওনাকে কেনো এত চেনা মনে হয় ? নিশ্চুপ,মামুন সাহেব। মেঝেতে লুটিয়ে পরে নীরা।কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় হাসপাতালের পরিবেশ। হঠাৎ মৃদুল,মৃদুল বলে নীরা`র আর্তচিৎকার।ততক্ষণে মৃদুলের মৃদু হাসি মিশ্রিত চোঁখের জল শুকিয়ে যায়। নিথর হয়ে যায় খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীর প্রাণহীণ শরীর।
শিক্ষক, লেখক -তজুমদ্দিন, ভোলা