বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (৯ মে)। ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার লালদিঘীর ফতেহপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ২০০৯ সালের ৯ মে মারা যান।
তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তার জন্মস্থান পীরগঞ্জ উপজেলার লালদিঘী ফতেহপুর গ্রামে উপজেলা প্রশাসন, পরিবার, উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলো ছাড়াও ড. ওয়াজেদ স্মৃতি সংসদ (ডিডব্লিউএসএস), ড. ওয়াজেদ ফাউন্ডেশন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে স্মৃতিচারণ, ফাতেহা পাঠ, কবর জিয়ারত, মিলাদ মাহফিল ও গরীবদের মধ্যে খাবার বিতরণসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও ড. ওয়াজেদ মিয়ার কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও জিয়ারত করাসহ সুবিধাজনক সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দোয়া ও মোনাজাত করা হবে।
প্রয়াত পরমাণু বিজ্ঞানীর ভাতিজা, পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পীরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আবু সালেহ মো. তাজিমুল ইসলাম শামীম জানান, মঙ্গলবার সকালে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে কর্মসূচির আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। এছাড়া ড. ওয়াজেদ স্মৃতি পরিষদ, রংপুর জেলা, মহানগর ও পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন থেকেও নানা কর্মসূচি রয়েছে।
সকাল দশটায় ড. ওয়াজেদ মিয়ার কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও কবর জিয়ারত করবেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দিবসটি উপলক্ষ্যে আলোচনা অনুষ্ঠান ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। একই দিনে বিকেলে রংপুর কারামতিয়া জামে মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে জেলা আওয়ামী লীগ যুবলীগ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি তার কর্মজীবনে মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। পিতা মরহুম আব্দুল কাদের মিয়া ও মাতা মরহুমা ময়জুন নেসার চার ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।
গ্রামের প্রাইমারি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি ও পীরগঞ্জ হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন শেষে তিনি ১৯৫২ সালে রংপুর শহরের সরকারি জেলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে এই স্কুল থেকে ডিস্টিংশনসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।
১৯৫৮ সালে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় এবং ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৬১-’৬২ শিক্ষা বছরের জন্য হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৩ সালের ১ এপ্রিল তিনি তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের চাকরিতে যোগ দেন।
১৯৬৩-’৬৪ শিক্ষা বছরে তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ‘ডিপ্লোমা অব ইম্পেরিয়াল কলেজ কোর্স’ কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের ‘ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে তাকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকার আণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে পদায়ন করা হয়।
আজন্ম সৎ, নির্লোভ ও নিখাদ দেশপ্রমিক এই পরমাণু বিজ্ঞানী ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ১৯৬৯ সালে ইতালির ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র তাকে অ্যাসোসিয়েটশিপ প্রদান করে। তিনি ওই গবেষণা কেন্দ্রে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির কার্লসরবয়ে শহরের ‘আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে’ আণবিক রিঅ্যাক্টর বিজ্ঞানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ভারতের আণবিক শক্তি কমিশনের দিল্লির ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি অনেক জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান বিষয়ক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তার অনেক গবেষণামূলক ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা এবং সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ সাত বছর নির্বাসিত জীবন কাটান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের পদার্থ বিজ্ঞান, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের ছাত্রদের জন্য দু’টি গ্রন্থ রচনা করেন।
তার লেখা ৪৬৪ পৃষ্ঠার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে এবং ৩২০ পৃষ্ঠার ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয়।
১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালের জন্য তিনি পর পর দু’বার বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি পর পর তিনবার ওই বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চার বছর তিনি বাংলাদেশ পদার্থ বিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৭ সালে দু’বছর মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তাছাড়া তিনি ওই বিজ্ঞান সমিতির আজীবন সদস্য। ১৯৮৯ সালে দু’বছর মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তাছাড়া তিনি ওই বিজ্ঞান সমিতির আজীবন সদস্য।
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরপর দু’টি দু’বছর মেয়াদকালের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি পর পর দুই দু’বছর মেয়াদকালের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।
এছাড়া তিনি ওই সমিতির একজন আজীবন সদস্য। ১৯৯১-১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার দু’বছর মেয়াদকালের জন্য তিনি ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানজীবী সমিতি’র সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তিনি ওই সমিতির একজন আজীবন সদস্য।
তিনি ঢাকার রংপুর জেলা সমিতির আজীবন সদস্য এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দু’বছর মেয়াদকালের জন্য এই সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এবং ঢাকার বৃহত্তম রংপুর কল্যাণ সমিতি, উত্তরবঙ্গ জনকল্যাণ সমিতি, রাজশাহী বিভাগীয় উন্নয়ন ফোরাম, বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদ এবং রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার মির্জাপুর বছির উদ্দিন মহাবিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন।
তিনি ২০০৯ সালের ৯ মে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
এইচআর