‘অবৈধ’ জালে নির্বংশ হচ্ছে মাছের পোনা, ধ্বংস হচ্ছে বনও

পাথরঘাটা (বরগুনা) প্রতিনিধি: প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০২৪, ০৪:২৯ পিএম
‘অবৈধ’ জালে নির্বংশ হচ্ছে মাছের পোনা, ধ্বংস হচ্ছে বনও

বরগুনার পাথরঘাটার নদ-নদী ও সমুদ্র উপকূলে অসাধু জেলেরা দেদারসে নিষিদ্ধ গোপজাল ব্যবহার শুরু করছেন। এতে পোনা মাছ তো বটেই, উপকূলের তিনটি শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) বন উজাড় করছে। এছাড়াও ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির পোনা মাছ নির্বংশ হচ্ছে। এক সপ্তাহ ধরে বিষখালী, বলেশ্বর ও সাগর মোহনাসংলগ্ন প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে ১৫টি চরে অন্তত ৫৮টি গোপজালের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই ১৫টি চর বন বিভাগের টেংরা, চরদুয়ানী, চরলাঠিমারা, পাথরঘাটা সদর ও হরিণঘাটা বিট এলাকায় পড়েছে।


খুব ছোট ফাঁসের নিষিদ্ধ একেকটি গোপজাল এক থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। জোয়ার এলে জালগুলো টানা হয়, এমন কোনো জলজ প্রাণী নেই, এ জালে আটকায় না। বিষখালী নদী, বলেশ্বর নদ ও সাগর মোহনায় চরে দীর্ঘ একেকটি জাল দেড় হাজার থেকে তিন হাজার খুঁটির মাধ্যমে পাতা হয়। এই খুঁটির জোগান দিতে হরিণঘাটা, টেংরা ও টুলুর চর এই তিন শ্বাসমূলীয় বনের গেওয়া আর কেওড়াগাছ নিধন চলছে। এ কাজে বন কর্মকর্তা, মৎস্য কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি ঘুষ লেনদেনের চক্র গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।


হরিণঘাটা শ্বাসমূলীয় বনটি প্রায় ১০ হাজার একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। টেংরা শ্বাসমূলীয় বন ১ হাজার একর, টুলুর চর শ্বাসমূলীয় বন ৩০০ একরে বিস্তৃত। এই তিন সংরক্ষিত বন উপকূলকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে। এসব বনে উদ্ভিদের মধ্যে কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী, ছইলা, গোলপাতা বেশি। আর প্রাণীর মধ্যে চিত্রা হরিণ, বন্য শূকর, বানর, কাঠবিড়ালির দেখা মেলে।


একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটা গোপজালের সঙ্গে ১০-১২ জন জেলে যুক্ত থাকেন। তাঁরা বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে। একেকটি জাল পাতার পর তুলতে ১-২ দিন সময় লাগে।


বিষখালী নদীর উত্তরপূর্ব দিক থেকে দক্ষিণের সাগর মোহনা হয়ে বলেশ্বর নদের উত্তর-পশ্চিম অংশে ১৫টি চর ঘুরে অন্তত ৫৮টি গোপজালের সন্ধান পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন ঘুষ লেনদেন মাধ্যমে ১৯টি জাল নিয়ন্ত্রণ করছে পাথরঘাটা সদর বিট। হরিণঘাটা বিটের নিয়ন্ত্রণে ৫টি, চরলাঠিমারা বিটের নিয়ন্ত্রণে ১২টি, টেংরা বিটের নিয়ন্ত্রণে ১৫টি এবং চরদুয়ানী বিটের নিয়ন্ত্রণে ৭টি গোপজাল রয়েছে।


বিষখালী ও বলেশ্বর নদের আশপাশে এলাকার বাসিন্দারা জানান, ছোট গোপজালও এক কিলোমিটারের কমে হয় না। বড়গুলো তিন কিলোমিটার দীর্ঘ হয়। বড় গোপজালে চার-পাঁচ হাজার খুঁটি ব্যবহার করা হয়। ১০ থেকে ১৫ হাত পরপর ওই খুঁটি ব্যবহার করা হয়। একই নিয়মে ছোট চরগড়া ও গোপজালে দুই-তিন হাজার খুঁটি ব্যবহার করা হয়। তিন থেকে চার মাস পরপর ওই খুঁটি পরিবর্তন করতে হয়। জোয়ার এলে এসব জাল রশির মাধ্যমে টানা হয়, তখন এতে সব ধরনের মাছ ধরা পড়ে।


বলেশ্বর ও এর তীর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সাগর মোহনার লালদিয়া থেকে উত্তরে চরদুয়ানী পর্যন্ত নদীর তীর থেকে এমনভাবে গোপজালের খুঁটি গাড়া রয়েছে, নদী থেকে ট্রলার চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তা ছাড়া জোয়ারে যখন খুঁটিগুলো ডুবে যায়, তখন ওই এলাকা থেকে যেকোনো ট্রলার বা নৌকা চলাচলে মারাত্মক ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া লালদিয়া থেকে চরদুয়ানী পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটারের বিশাল এলাকাজুড়ে চরগড়া ও গোপজালে জোয়ারে ঢুকে ভাটায় মারা পড়ছে ছোট ছোট পোনা মাছ।


জানতে চাইলে বন বিভাগ পাথরঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, বনের গাছ কেটে চরগড়া জাল (গোপজাল) ব্যবহার করতে আমরাও দেখছি। তাঁদের বারবার বাধা দিলেও মানছেন না। ঘুষ লেনদেনে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে বন বিভাগের কর্মচারী জড়িত থাকার কথা বলেন তিনি। পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. তারিকুল ইসলাম জনবলসংকটে অভিযানের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেন, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতায় এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, গোপজালে মাছের বংশবিস্তার হুমকিসহ পোনা মাছ মারা পড়ছে। বিষয়টি ২২ নভেম্বর উপজেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় উত্থাপন করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। বিষয়টি পৃথকভাবে পাথরঘাটা কোস্টগার্ড, পাথরঘাটা মৎস্য দপ্তর ও বন বিভাগকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।


বিআরইউ