লন্ডনে টিউলিপের বোনকে দেওয়া বিনামূল্যে ফ্ল্যাটের সন্ধান

আমার সংবাদ ডেস্ক প্রকাশিত: জানুয়ারি ৫, ২০২৫, ০৫:২৬ পিএম
লন্ডনে টিউলিপের বোনকে দেওয়া বিনামূল্যে ফ্ল্যাটের সন্ধান

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও তার বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের লন্ডনে আরও একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে। ফ্ল্যাট উপহার নেওয়ার খবর প্রকাশের পর ক্রমবর্ধমান তদন্তের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের এই সিটি মিনিস্টার। এ নিয়ে পদত্যাগের জন্য চাপেও পড়েছেন তিনি। কারণ হিসেবে জানা গেছে, লন্ডনে ফ্ল্যাট উপহার পাওয়ার বিষয়ে মিথ্যা বলেছেন তিনি।

জানা গেছে, বাংলাদেশের সাবেক আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংশ্লিষ্ট একজন সহযোগীর থেকে ওই ফ্ল্যাট উপহার নেন তিনি।

ফিনান্সিয়াল টাইমসের পর এবার এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য সানডে টাইমস।

দ্য সানডে টাইমস বলছে, টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন লেবার মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি ইকনোমিক সেক্রেটারি টু দ্য ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার কাজ যুক্তরাজ্যের অর্থবাজারের ভেতরের দুর্নীতি সামাল দেওয়া। এদিকে বাংলাদেশে তার এবং তার পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে ও এ নিয়ে তদন্তও চলছে।

সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালে বাংলাদেশি আইনজীবী মঈন গণি উত্তর লন্ডনের ওই ফ্ল্যাটটি টিউলিপের বোন আজমিনা সিদ্দিকের নামে হস্তান্তর করেন। পরে আজমিনা বিনামূল্যে এই ফ্ল্যাটটি টিউলিপকে ব্যবহার করতে দেন।

এদিকে ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শনিবার রাতে দেশটির এমপিরা জানান, যদি টিউলিপ এই ঘটনার ব্যাখ্যা না দেন তবে তাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে।

হারো ইস্টের এমপি বব ব্ল্যাকম্যান বলেছেন, টিউলিপকে তার সম্পত্তির ব্যাপারে অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। যদি তিনি তা না করেন, তবে মন্ত্রী হিসেবে তার অবস্থান অযোগ্য হয়ে পড়বে।

দেশটির ছায়া হোম অফিস মিনিস্টার ম্যাট ভিকার্স বলেছেন, এ ধরনের অভিযোগ কোনো সরকারের সদস্যের বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টি আরও বিতর্কের সৃষ্টি করে যখন অভিযুক্ত মন্ত্রী নিজেই দুর্নীতি দমনের সঙ্গে  জড়িত।

তবে সব অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার জানান, টিউলিপ সিদ্দিকের ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তিনি তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, আর্থিক অপরাধ ও দুর্নীতি মোকাবিলার দায়িত্বে থাকা ট্রেজারি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেডে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। তার বোন আজমিনাকে ব্যবহারের জন্য দেওয়ার পরে টিউলিপ ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন।

হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটি লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকার কাছের অ্যাপার্টমেন্টটি থেকে ভিন্ন। কিংস ক্রস এলাকার কাছের অ্যাপার্টমেন্টটি ২০০৪ সালে টিউলিপ বিনামূল্যে পান। তিনি এখনও এই অ্যাপার্টমেন্টটির মালিক।

যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধনসংক্রান্ত নথিপত্রে বলা হয়েছে, অর্থ বা আর্থিকমূল্য রয়েছে, এমন কিছু ছাড়াই হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটি আজমিনাকে দেওয়া হয়েছে।

হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটির বিষয়ে টিউলিপ কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার বোনের এই ফ্ল্যাটটিতে বসবাস করেছিলেন, যা অনেক পরিবারের জন্য সাধারণ একটি বিষয়।

আরেকটি সূত্র বলছে, ২০১৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত একটি পারমাণবিক শক্তি চুক্তিতে টিউলিপ মধ্যস্থতা করেছেন। এই চুক্তি থেকে লাভবান হয়েছেন বলে যে অভিযোগ, তা অনুসন্ধান করার কথা সম্প্রতি জানায় বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে টিউলিপ বলেছেন, তিনি ভুয়া অভিযোগের ভুক্তভোগী।

টিউলিপের ওই ফ্ল্যাটে ওঠার সময়কাল ঠিক স্পষ্ট নয়। তবে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে টিউলিপ ওয়ার্কিং মেনস কলেজের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি নথিতে তার ঠিকানা হিসেবে ফ্ল্যাটটি তালিকাভুক্ত করেন।

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ক্যামডেন আর্টস সেন্টারের ট্রাস্টি হওয়ার পর, ২০১৪ সালের মার্চে হ্যাম্পস্টেড ওয়েলস অ্যান্ড ক্যাম্পডেন ট্রাস্টের ট্রাস্টি হওয়ার পরও তিনি একই ঠিকানা ব্যবহার করেন। এ ছাড়া তার স্বামী ক্রিশ্চিয়ান পার্সি ২০১৬ সালের মে মাস পর্যন্ত এটিকে তার ঠিকানা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিলেন।

টিউলিপের বোন আজমিনার টনি ব্লেয়ার’স ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তিনি সম্প্রতি শিশুদের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেছেন। ফ্ল্যাটটি ২০২১ সালে ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করে দেন তিনি।

ফ্ল্যাটটির আগের মালিক আইনজীবী মঈন গণি আন্তর্জাতিক বিরোধসংক্রান্ত বিষয়ে কয়েক বছর বাংলাদেশের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। ২০২১ সালে শেখ হাসিনা সরকার ২০২১ সালে তাকে বিশ্বব্যাংক প্যানেলে একটি পদে মনোনীত করেন।

তখন মঈন ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ পাওয়াটা আমার জন্য একটি সম্মান।

ফিঞ্চলেতে ২.১ মিলিয়ন মূল্যের ম্যানসন

টিউলিপ উত্তর লন্ডনের ফিঞ্চলেতে ২ দশমিক ১ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি ম্যানসনে থাকেন। এটি আগে লরেন পোপ নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন ছিল। তিনি একজন রিয়েলিটি টিভি তারকা। কিন্তু দুই বছর আগে আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার কার্যনির্বাহী সদস্য আবদুল করিম নাজিমের মালিকানাধীন একটি কোম্পানি এটি কিনে নেন।

নাজিম ২০২২ সালে সিদ্দিককে বাড়িটি ভাড়া দিতে শুরু করেন। পরের বছর, তিনি হাসিনা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাকে তখন বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) সম্মান দেওয়া হয়। একইসঙ্গে তিনি শেখ হাসিনার দলের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ব্যাংকের উপ-চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান।

২০২৩ সাল থেকে, নাজিমের পাঁচটি কোম্পানিকে বাধ্যতামূলকভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে, কারণ তারা সময়মতো বা সম্পূর্ণরূপে হিসাব জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

একটি সূত্র বলেছে, টিউলিপ নিরাপত্তার কারণে নাজিমের বাড়িতে ওঠেন। নিরাপত্তার কারণেই সেখানে তিনি থাকছেন।

টিউলিপের মুখপাত্র বলেন, তিনি ও তার স্বামী বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হারে ভাড়া দিয়ে থাকেন।

গোল্ডার্স গ্রীনে ১.২ মিলিয়ন মূল্যের বাড়ি

টিউলিপের মা শেখ রেহানা উত্তর লন্ডনের গোল্ডার্স গ্রীনে একটি ফ্ল্যাটে বাস করেন। অনুসন্ধানী সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট নেত্র নিউজের প্রতিবেদন অনুসারে, এটির মালিক সায়ান রহমান। তিনি শেখ হাসিনার উপদেষ্টার (সালমান এফ রহমান) ছেলে। শেখ হাসিনার পতনের পর সায়ান রহমানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। একটি ব্যাংকের বোর্ড থেকে তাকে অপসারণ করা হয়। তার বাবা এখন কারাগারে আছেন।

হ্যাম্পস্টেডে ৫ লাখ পাউন্ডের ফ্ল্যাট

টিউলিপের বোন ও মা হ্যাম্পস্টেডের উল্লিখিত ফ্ল্যাটটির কাছের একটি ফ্ল্যাটে কিছু সময়ের জন্য বসবাস করেছিলেন। এটি আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জাফর উল্লাহর মালিকানাধীন। তিনি এটি ২০০৭ সালে কিনেছিলেন। ২০১২ সালে ৪ লাখ ৯৯ হাজার পাউন্ডে এটি তিনি বিক্রি করে দেন।

আশ্চর্যজনকভাবে আইনজীবী গণিও বেশ কয়েক বছর ধরে এটিকে তার ঠিকানা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিলেন।

২০০৭ সালে, যখন এটি কেনা হয়, জাফরুল্লাহকে বাংলাদেশে চাঁদাবাজির জন্য কারাগারে পাঠানো হয়। ২০১৬ সালে, তাকে একটি অফশোর ট্রাস্টের নেটওয়ার্কের লাভভোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হাসিনা সরকারের পতনের পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান হওয়ার কারণে।

আরএস