গত সাত মাসে কারা অধিদপ্তরের ১২ জনকে চাকরিচ্যুত, ছয়জনকে বাধ্যতামূলক অবসর, ৮৪ জনকে সাময়িক বরখাস্ত, ২৭০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি এবং ২৬০ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
নানা অনিয়ম, আর্থিক লেনদেনসহ অসদুপায় অবলম্বনের অভিযোগে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন।
সোমবার (১০ মার্চ) দুপুরে পুরান ঢাকার বকশিবাজারে কারা অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
আর্থিক লেনদেন ব্যতীত কারাগারে বন্দিদের তাদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী খাবারসহ অন্যান্য সুবিধাদি নিশ্চিতের জন্য জেল সুপার এবং ডিআইজিদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন।
তিনি বলেন, নিয়ম ভঙ্গকারী কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের কোনোরূপ ছাড় দেওয়া হচ্ছে না এবং নিয়ম ভঙ্গকারীদের অতি দ্রুততার সঙ্গে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে। তারই ফল স্বরূপ সাত মাসে ১২ জনকে চাকরিচ্যুত, ৬ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর, ৮৪ জনকে সাময়িক বরখাস্ত, ২৭০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান, বিভাগীয় মামলা দায়ের ২৬০ জনের বিরুদ্ধে, ২৯ জনকে কৈফিয়ত তলব, ২১ জনকে চূড়ান্ত সতর্ক, ৩৯ জনকে তাৎক্ষণিক বদলি এবং ১০২ জনকে প্রশাসনিক কারণে বিভাগের বাইরে বদলি করা হয়েছে।
কারা মহাপরিদর্শক বলেন, কারা সদর দপ্তর নিশ্চিত করছে যে, বর্তমান প্রশাসন প্রমাণসহ যেকোনো ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সব কারাগারকে স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতামূলক হিসেবে গড়ে তুলার লক্ষ্যে বর্তমান প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। ‘রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’ এই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে বাংলাদেশ জেল ডিপার্টমেন্টকে একটি মানবিক সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলার জন্য ইতোমধ্যেই নানামুখী সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন।
বন্দি ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়নের নানা কার্যক্রমের ফিরিস্তি তুলে ধরে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১. দেশব্যাপী বন্দি সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য সংগ্রহের জন্য হটলাইন চালু করা।
২. বন্দিদের সাক্ষাৎকারে ভোগান্তি কমানোর জন্য ডিজিটাল ভিজিটর ম্যানেজমেন্ট চালু করা।
৩. আভ্যন্তরীণ বন্দি ব্যবস্থাপনা সহজীকরণের লক্ষ্যে comprehensive বন্দি ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার চালু করা। যাতে, পিসি ক্যাশ, টেলিফোন কথোপকথন, ক্যান্টিন ম্যানেজমেন্ট এবং বন্দিদের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং ধাপে ধাপে তা আর এফ আইডির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে।
৪. গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালনকারী কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বডি ক্যাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করণ, ৬৯টি কারাগারকে নিজস্ব ফাইবার নেটওয়ার্ক কানেকটিভিটির আওতায় আনায়ন যা কারা ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও নিরাপত্তা জোরদারে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
৫. বড় কারাগারগুলোকে সৌর বিদ্যুতের আওতায় আনা হচ্ছে। যাতে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ প্রাপ্তির নিশ্চিত করাসহ সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্বও সাশ্রয় হবে।
বাংলাদেশের কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতার তুলনায় অতিরিক্ত বন্দির অবস্থান একটি সার্বক্ষণিক সমস্যা উল্লেখ করে সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন বলেন, এ ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার-২ (যা মেট্রোপলিটন কারাগার হিসেবে পরিচিত) চালু করা হয়েছে এবং কেরাণীগঞ্জে আরেকটি বিশেষ কারাগার চালুর উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এছাড়া রংপুর, রাজশাহীসহ বেশ কয়েকটি পুরোনো কারাগার সম্প্রসারণের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। বন্দিদের নিরাপদ উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণের প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
বন্দিদের কারাগারের বাহিরে যাতায়াত নিরাপদ এবং ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য আধুনিক জিপিএস ট্রাকারযুক্ত এ্যাংকেল ব্যান্ড লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বোপরি কোনো আর্থিক লেনদেন ব্যতীত বন্দিদের তাদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী খাবারসহ অন্যান্য সুবিধাদি নিশ্চিতের জন্য জেল সুপার এবং ডিআইজিদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গকারী কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের কোনোরূপ ছাড় দেওয়া হচ্ছে না এবং নিয়ম ভঙ্গকারীদের অতি দ্রুততার সঙ্গে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে।
বর্তমান প্রশাসন কারা কর্মকর্তা কর্মচারীদের মনোবল বৃদ্ধিসহ তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে অন্যতম হল- কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন ব্যতীত সৎ, যোগ্য, কর্মোদ্যোমী ব্যক্তিবর্গকে গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং স্থাপনায় পদায়ন। এছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- জনবল সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে নতুন ১৮৯৯টি পদ সৃষ্টি করা, দীর্ঘ ১৪ বৎসর পর সিনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জট খোলা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অর্জিত ছুটি নিশ্চিতকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ, প্রত্যাশা Apps এর মাধ্যমে সব স্তরের মতামত প্রকাশের ব্যবস্থাকরণ, একই স্থানে দীর্ঘদিন যাবত কর্মরত থেকে অনিয়মের সিন্ডিকেটকারীদের পোস্টিং এর আওতায় আনা, সব পদবির জন্য নতুন প্রশিক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন, সবার মতামত গ্রহণপূর্বক নতুন নিয়োগবিধির খসড়া চূড়ান্তকরণ, স্বাস্থ্য স্কিমের আওতায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বর্ধিত সহায়তা প্রদান, পরিবার নিরাপত্তা প্রকল্পের আওতায় আনুতোষিক বৃদ্ধি, Team Tracker এর মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ। এছাড়া Bangladesh Prisons and Correction Services Acts এর খসড়াও চূড়ান্ত করা হয়েছে। কারা গোয়েন্দা ইউনিটকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও কারা কল্যাণ সমিতির কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে কারা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তা কার্যক্রম বৃদ্ধির উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।
এতো স্বল্প সময়ে উল্লিখিত সংস্কার সত্ত্বেও বিগত ১৫ বছরের কিছু সুবিধাভোগী অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বন্দিরা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বাহিরের কিছু অসাধু ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও ব্যক্তিকে প্ররোচিত করে কারাগার সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ, প্রপাগান্ডা, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক অবান্তর ও অবাস্তব ঘটনার অবতারণা করে অধিদপ্তরের ভাবমূর্তি বিনষ্টের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। তারা কারাগার সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তিও ছড়াচ্ছে।
এক্ষেত্রে কারা অধিদপ্তর দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানাতে চায়, কারাগারের আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাসহ অনিয়ম দুর্নীতি দূর করার জন্য কারা সদর দপ্তর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কারাগারকে মাদক এবং মোবাইল মুক্ত করার জন্য গত ৩ মাসে শুধুমাত্র কেরাণীগঞ্জ কারাগারেই ২৭৫টি ঝটিকা তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং ফলস্বরূপ কারা অভ্যন্তর থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছোট বাটন ফোন এবং মাদক উদ্ধার সম্ভব হয়েছে।
এছাড়া প্রশাসনের তৎপরতায় কারাগারে মাদক প্রবেশ করানোর বেশ কয়েকটি উদ্যোগও ব্যর্থ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ক্যান্টিন দ্রব্যসামগ্রীর মান এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।
বন্দিদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী, খাবার নিশ্চিতের জন্য কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। কারা হাসপাতালে টাকার বিনিময়ে অবস্থানের সুবিধা কঠোর নজরদারির কারণে বহুলাংশে হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে।
এতো নজরদারির পরও কারা অধিদপ্তর মনে করে অনেক ক্ষেত্রে আরও উন্নতির অবকাশ রয়েছে। বিশেষ করে গত ১৫/১৬ বছরের অনিয়ম দুর্নীতিতে অভ্যস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনা সহজ নয়, কিন্তু তা চলমান রয়েছে এবং আমরা আশাবাদী অদূর ভবিষ্যতে এর সুফল কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ কারাগারের সেবা প্রত্যাশীরা উপভোগ করবে।
একটি মহল দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে দাবি করে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছরের অনৈতিক সুবিধাভোগীদের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দ্রুত সংস্কার/পরিবর্তন করা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। তথাপিও কারা বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সহযোগিতা চান তিনি।
তিনি আরও বলেন, সংরক্ষিত এলাকা এবং বর্তমান সময়ে সাবেক মন্ত্রী-আমলা ও আলোচিত ব্যক্তিবর্গ কারাগারে আটক থাকায় কারাগারের প্রতি সবার আগ্রহ অনিবার্য। কারা প্রশাসনকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য অপরাধীরা সব সময়েই সচেষ্ট থাকে, আর তাদের দোসররা বাইরে থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সমাজ/দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালায়। এজন্য গণমাধ্যমের গঠনমূলক সমালোচনা কারাগারের সংস্কারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার পাশাপাশি জুলাই বিপ্লবের চেতনার আলোকে দুর্নীতি ও রাহুমুক্ত কারা প্রশাসন গড়তে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে কারা উপমহাপরিদর্শক (ঢাকা) জাহাঙ্গীর কবীর, কারা উপমহাপরিদর্শক (সদর দপ্তর) মনির আহমেদ, সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মো. আবু তালেব, সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন ও মিডিয়া) মো. জান্নাত উল ফরহাদসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আরএস