বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) বিদ্যমান আইন ২০১০-এর পঞ্চম ধারায় ‘কাউন্সিলের ক্ষমতা’-এর ২৩ নম্বর উপধারার বর্ণনা অনুযায়ী ‘তফসিলভুক্ত বা তফসিল বহির্ভূত বাংলাদেশের বাইরে এবং ভেতরের যেকোনো মেডিকেল বা ডেন্টাল চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ডিগ্রি বা ডিপ্লোমার মান মূল্যায়ন বা পুনঃমূল্যায়ন করে সংশ্লিষ্ট তফসিল সংশোধন’ অর্থাৎ ক্ষেত্রবিশেষে বা প্রয়োজন অনুসারে কাউন্সিলের তফসিল সংশোধনের উদ্যোগ নিতে পারবে। বিদ্যমান আইনে কাউন্সিল নিবন্ধিত হয়নি এমন সকল কোর্সের মানদণ্ড যাচাই-বাছাই করে তফসিল সংশোধন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বিএমডিসির নিজস্ব সক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ নতুন কোনো কোর্স যা কিনা বিএমডিসি আইনের সর্বশেষ সংশোধনীর পর জন্ম নিয়েছে তাদের বিষয়টি আমলে নিতে বিএমডিসির কোনো নিয়মতান্ত্রিক বাধা নেই। তাহলে আসলে বাধার জায়গাটি কোথায়?
বিএসসি ইন হেলথ/মেডিকেল টেকনলোজি ডেন্টাল ডিগ্রিধারীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিএমডিসির লিখিত ব্যাখা অনুযায়ী কোর্স টাইটেল ‘টেকনোলজি’ শব্দযুক্ত কোনো কোর্সকে অর্থাৎ মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের বিদ্যমান আইনে রেজিস্ট্রেশন দিতে বিধিবিধান নেই অথচ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) বিদ্যমান আইন ২০১০-এ কোনো ধারা বা উপধারায় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বা ডেন্টাল টেকনোলজিস্টদের বা কোর্স টাইটেল টেকনোলজি শব্দযুক্ত কোনো কোর্সকে প্রাইভেট প্র্যাকটিস রেজিস্ট্রেশন দেওয়া যাবে না মর্মে কোনোধরনের বিধান বা নিষেধ নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, প্রথমত বিএসসি ইন হেলথ টেকনলোজি ডেন্টাল পাসকরা গ্র্যাজুয়েটদের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হিসেবে পদবী নির্ধারণ করার মতো কোনো এখতিয়ার আদৌ কি তাদের আছে? কেননা এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে বিএসসি ডিগ্রিধারীদের জন্য পদ পদবী সৃষ্টি করা হয়নি এমনকি সরকারিভাবে প্রদত্ত এমন কোনো নির্দেশনাও নেই যার রেফারেন্স হিসেবে এ পদবীর দায় তারা চাপিয়ে দিতে পারে।
আর যদি তর্কের খাতিরে তাদের কথা যদি সত্য বলেই ধরেই তাহলে তো বিদ্যমান আইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে বা দেখাতে হবে তাই নয় কি? ঠিক কোন ধারা বা উপধারায় ‘টেকনোলজিস্টদের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয় না’ সেটি উল্লেখ রয়েছে। নাকি তাদের রেফারেন্সবিহীন মুখের কথায় আসলে আইন?
যদি বর্হিবিশ্বের উদাহরণ হিসেবে বলে থাকেন যে বাইরের দেশে টেকনোলজিস্টদের ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিশনার হিসেবে কোথাও লাইসেন্স দেওয়া হয় না আমাদের দেশে কেন দেওয়া হবে? দেশের বাইরে টেকনোলজিস্টদের আসলে কি পড়ানো বা শিখানো হয়? তাদের কোর্স কারিকুলাম ও বাংলাদেশের প্রচলিত কোর্স কারিকুলাম কি একই? উত্তর হলো না। বর্হিবিশ্বের টেকনোলজি কোর্স কারিকুলাম বাংলাদেশের প্রচলিত কোর্স কারিকুলাম থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা।
তাহলে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, শুধুমাত্র মৌখিক বা লিখিত বিবৃতি দিয়েই ক্লিনিক্যাল কারিকুলামকে টেকনোলজিস্ট বলে চালিয়ে দেওয়া যায় কিনা? কেননা কোর্স কারিকুলামের কোনোপ্রকার যাচাই-বাছাই না করে, শুধুমাত্র ধারণা প্রসূতভাবে এভাবে প্রত্যাখান করা শুধুমাত্র তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থরক্ষার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছু নয়।
একটি রাষ্ট্র আইন কেন তৈরি করে? উত্তরটি যদি জনকল্যাণের জন্যই আইনের উদ্ভব হয়ে থাকে তাহলে জনস্বার্থে এ বিএমডিসি নামক প্রাতিষ্ঠানিক আইনটির একটি তফসিল সংশোধনে সমস্যা কোথায়? এটি তো কোনো ধর্মীয় বিধিমালা নয়, যা পরিমার্জন বা সংশোধন সম্ভব নয়? একটি দেশের সংবিধান সে দেশের সবচাইতে বড় আইন এবং তা হয়েও জনকল্যাণ, সময় ও চাহিদার প্রয়োজনে সেটিকেও সংশোধন বা পরিমার্জন করা হয় করা বা হয়েছে তাহলে এ প্রাতিষ্ঠানিক আইনের ধারা সংশোধনে অসুবিধা কোথায়? যেখানে সংবিধানের ৪০ ধারায় ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হিসেবে পেশাচর্চার অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
মূল সমস্যা হলো, সদিচ্ছার আর দ্বিতীয়টি হলো কেউ যোগ্য হলেও স্বীয় স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা থেকেই এসব লুকোচুরি। বিএমডিসি নামক এই ‘রেগুলেটরি বডি’র কাছে জনকল্যাণের চেয়ে গোষ্ঠীদরদ বেশি।
বিডিএস ডিগ্রিধারীদের প্রায় সাদৃশ্যপূর্ণ কারিকুলামে অধ্যয়ন করা, ক্লিনিক্যাল ডেন্টাল প্র্যাকটিসের উপযুক্ত বিষয় পড়াশুনা, এক বছর হাসপাতাল ট্রেনিং করার পর শুধুমাত্র বিরোধিতার খাতিরে একটি সমপর্যায়ের কোর্সকে ডুবিয়ে, পঁচিয়ে প্রশাসন ও জনসাধারণের দৃষ্টিতে এদের ভুয়া প্রমাণ করতে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি এবং প্রতিনিয়তই দেখছি।
বিশ্বে স্বাস্থ্য জনবলের কতটা সংকট কোভিড মোকাবিলা করতে গিয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই তা পরিলক্ষিত করেছে এবং প্রায় সবাই এ ক্রাইসিসের ভুক্তভোগী। তবুও মন্ত্রণালয় বা বিএমডিসি এ যৌক্তিক বিষয়গুলোকে আমলে নিতে চায় না কেন?
বিএসসি ইন হেলথ টেকনলোজি ডেন্টাল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে ২০১২ সালে দীর্ঘ আট মাসেরও বেশি সময় ধরে চলমান অহিংস যৌক্তিক আন্দোলন ও যৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতর অনেকটা বাধ্য হয়েই একটি নয় সদস্য বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে যেখানে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ডেন্টাল এক্সপার্টদের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির বিষয়ে পজিটিভ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তার ধারাবাহিকতায় ৩১ জানুয়ারি ২০১৩, পরিচালক, মেডিকেল এডুকেশন কোর্সের নাম পরিবর্তনসহ কোর্স অনুমোদন করে পাস করার পর ডিগ্রিধারীদের বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন দিতে অনুরোধ করেন।
ওই অফিস আদেশের আগে স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে তৎকালীন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ডেন্টাল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান যিনি ডেন্টাল সোসাইটির বর্তমান মহাসচিব তার সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে একটি ঘরোয়া মিটিংয়ে মহাসচিব মহোদয় শিক্ষার্থীদের এ দাবিটির যৌক্তিকতা স্বীকার করেন এবং কোর্সের টাইটেল পরিবর্তন ব্যতিরেকে কেবলমাত্র সীমিত আকারে প্র্যাকটিসের বিষয়ে উনার অভিমত ব্যক্ত করেন এবং তদসংশ্লিষ্ট সুপারিশও উনি করবেন বলে সম্মত হন। কিন্তু পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাব স্বাস্থ্য অধিদফতর সুপারিশ করলে তাদের মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয় এবং সুপারিশ বাতিলের আন্দোলনে সকলে এক হয়ে যায়।
সময় বহু গড়িয়েছে, পেশায় রাজনীতি ও অপরাজনীতি দুইয়েরই অনুপ্রবেশ ঘটেছে, পেশাগত বহু চ্যালঞ্জের মুখে পুরনো দিনের সত্যগুলো হাজারো অপপ্রচারের জোয়ারে আজ মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। দেশে ডেন্টাল প্র্যাকটিসে আর ২ হাজার দক্ষ মানুষ সংযুক্ত হলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কি ভেঙে পড়বে নাকি দেশের মানুষের কিঞ্চিৎ হলেও কল্যাণ সাধিত হবে?
সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত জনবলকে যেখানে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার নানামুখী কার্যক্রম হাতে নিয়েছে শুধু তা-ই নয় পেশাগত শিক্ষায় শিক্ষিত গোষ্ঠীকেও নানাবিধ দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণও দিচ্ছে তাহলে এতবড় একটা সুপ্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মূল ধারার বাইরে রাখার ক্ষেত্রে কি-ই বা যুক্তি থাকতে পারে!
স্বাস্থ্য কাঠামোয় সুষ্ঠ ও সমুন্নত উন্নয়নে এ জনগোষ্ঠী সহায়ক ভূমিকায় নিঃসন্দেহে অবতীর্ণ হতে পারে যেখানে সরকার বা প্রশাসনের সদিচ্ছাই যথেষ্ট কেননা এখানে কোনো আর্থিক অনুদান, বাজেট এলোকেশনের প্রয়োজন নেই। উপরন্তু সরকারি কোষাগার এ সকল ব্যক্তিদের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হওয়ার বহুমাত্রিক সুযোগ রয়েছে।
প্রশাসন বা সরকারের কাছে পেশাগত আধিপত্যের জায়গায় ডেন্টাল সোসাইটির বা বিডিএস ডিগ্রিধারীরা সম্মুখ সারিতে এমনকি তারা নিজেরাও প্রশাসনের পদ-পদবীতে অবস্থান করছেন। ফলে যৌক্তিকতা থাকলেও খুব সহজে প্রশাসন নামের ভাগ্যবিধাতা আমাদের ভাগ্যের সহায় হবেন এ ধারণা দিন দিন ক্ষীণপ্রায়, কারণ সমাজের উঁচু স্তরের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত কোনো বিষয়েই প্রশাসনের কাছে গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিতে এগিয়ে থাকে। সমাজের নিম্নস্তর থেকে যে ‘ভয়েস রেইজ’ করা হয় তা বহুতল ভবনের দেয়াল অব্দি পৌঁছে তা প্রতিধ্বনিত হয়ে নিম্নের স্তরেই ফেরত আসে। কাল পরিক্রমায় নিখাঁদ সত্যও মিথ্যার প্রবাহমান স্রোতে হারিয়ে যেতে বসে।
আইনি কাঠামোর দ্বারা পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান যখন যুক্তি বিবেচনা না করে কেবলমাত্র বিশেষ গোষ্ঠীস্বার্থের জন্য আইনের অযুহাতকে জাতীয় সমস্যার সমাধানের বিপরীতে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে তখন সেটি অধিকার হরণের পর্যায়েই পড়ে। বিএসসি ডেন্টাল ডিগ্রিটি ঘিরে যে মহাসংকট দেখা দিয়েছে, এর দায় কে নেবে?
লেখকঃউত্তম কুমার
পরিচিতঃ মহাসচিব, বিএসসি ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন।