ইসলাম ইজ দ্য কমপ্লিট কোড অব লাইফ। ইসলাম নামক এই পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানটি প্রবর্তনের আগে পৃথিবীর সমাজ ও সভ্যতার এক নিদারুণ সংকট চলমান ছিল। ইতিহাসের ভাষায় সেই সময়টিকে "আইয়ামে জাহিলিয়া" বলা হত। সেই অন্ধকারের যুগে অনেক নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য সমাজ দেহকে কলুষিত করে রেখেছিল। মানবতার সবচেয়ে গভীর সংকটটি ছিল সহিষষ্ঞতার সহনশীলতা "জোর যার মুল্লুক তার" এ নীতিই ছিল সর্বত্র। সমাজে ছিল চরম পর্যায়ে অসহনশীলতা। এরকম একটি সমাজ ব্যবস্থাতেই আশা ও আলোকের বাতিঘর হিসাবে আবির্ভাব ঘটেছিল ইসলামের।
পরবর্তী সময়ে মানব সমাজে পথ চলার প্রতিটি পদক্ষেপে ইসলামের সহনশীলতা কে অনুশীলন করেছে ,অগ্রাধিকার দিয়েছে। জীবন বিধান হিসেবে যিনি ইসলামের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন; গোটা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসেবে তাঁকে আমরা মহান আল্লাহ নামে ডাকি। সেই আল্লাহপাক তাঁর পরিচয়ে পবিত্র কোরআনের প্রথম সুরার প্রথম আয়াতেই যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানেই রয়েছে বিশ্বমানবতার প্রতি সহনশীলতা, দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসার কথা।
তিনি বলছেন, `আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন`। অর্থাৎ প্রশংসা করো সেই মহান সত্তার, যিনি সমগ্র বিশ্বের সবার রব। এখানে রব মানে হলো সৃষ্টজীবের যা কিছুর প্রয়োজন, সবকিছুর যিনি আয়োজন করেন, তাঁকেই বলা হয় রব। সুতরাং এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইসলামের মহান স্রষ্টা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে গোটা সৃষ্টিলোকের জন্য একদিকে যেমন অভিভাবকত্বের ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের বার্তা দিচ্ছেন, অন্যদিকে সৃষ্টিকুলের সবার রব হিসেবে পরিচয় দিয়ে তিনি নিজেকে সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন সত্তায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন।
পবিত্র কোরআনের অনেক জায়গায় মহান আল্লাহ তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে নিজেকে সৃষ্টির প্রতি অতীব সহনশীল বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা এ বিষয়ে ৩টি আয়াতের রেফারেন্স দিতে পারি- ১. ওয়াল্লাহু গাফুরুন হালিম (সুরা বাকারা-২২৫) অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা অতীব ক্ষমাশীল এবং পরম সহনশীল; ২. ওয়াল্লাহু গানিয়্যুন হালিম (সুরা বাকারা-২৬৩) অর্থাৎ আল্লাহপাক অভাবমুক্ত, পরম সহনশীল; ৩. ইন্নাহু কানা হালিমান গাফুরা (সুরা বনি ইসরাইল-৪৪) অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম সহনশীল এবং ক্ষমাপরায়ণ।
ইসলাম যাঁর মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ পেল তিনি হলেন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম । তাঁর জীবন, কর্ম ও আদর্শে সহনশীলতার যে মহান শিক্ষা রয়েছে তা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে গোটা পৃথিবীর মানুষের জন্যই এক অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁকে ঘোষণাই করা হয়েছে সমগ্র সৃষ্টির জন্য করুণার প্রতীক হিসেবে। জগতবাসীর জন্য তাঁর আবির্ভাবই হয়েছে আশীর্বাদ হিসেবে। তিনি সৃষ্টির প্রতি কতটা সহনশীল, এ থেকেই অনুমেয়। তাঁর কীর্তিময় জীবনের বাঁকে বাঁকে অজস্র ঘটনা এমন রয়েছে, যেসবের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাঁকে বিশ্বমানবতার পরম সুহৃদ ও সৃষ্ট জীবের প্রতি অতিশয় সহনশীল হিসেবে দেখতে পাই।
অমুসলিম মেহমানের সেবা, আগত মেহমান কর্তৃক অসদাচরণ করার পরও তার প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠা, মদিনার মসজিদে প্রস্রাব করে দেওয়ার পরও অমুসলিম ব্যক্তির প্রতি তাঁর সহনশীলতা প্রদর্শন, মক্কা বিজয়ের পর অমুসলিম নাগরিকদের বিষয়ে সংশ্নিষ্টদের প্রতি তাঁর নির্দেশনা, তায়েফের ঘটনায় পাথর-বৃষ্টিতে রক্তাক্ত হওয়ার পরও তাদের জন্য প্রার্থনা, অত্যাচারী মানুষদের ধ্বংস করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েও তাদের প্রতি রহমশীল হওয়া, শিরশ্ছেদ করতে আসা ব্যক্তিকেও প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া, প্রিয় চাচা হামজার কলিজা চিবিয়ে খাওয়া বর্বর হিন্দাকেও ক্ষমা করে দেয়া, বিষ-প্রয়োগে হত্যা করতে চাওয়া ব্যক্তির প্রতি উদারতা প্রদর্শন- ইত্যাদি অসংখ্য ঘটনায় তিনি যে সহনশীলতার অবিশ্বাস্য নজির স্থাপন করেছেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে তা বিরল।
আজ সহনশীলতার কথা বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে তা পালন করা হয় না। মহান আল্লাহ, ইসলাম ও প্রিয় নবীজির অনুপম আদর্শ আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। আমরা যা বলি আর আমরা যা করি, এ দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সে জন্যই আমাদের সমাজে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার উদ্ভব ঘটে। এসব ঘটনার অধিকাংশই সংঘটিত হয়ে থাকে ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারের অপপ্রয়াসের কারণে।
আমাদের অধিকাংশেরই মূল সমস্যা এখানেই। আমরা নিজ ধর্ম সম্পর্কে জানি না, আনুগত্য করি না এবং অন্য ধর্মের প্রতিও সম্মান দেখাই না; বরং ভিন্নমত-ধর্মের মানুষদের অবজ্ঞা করি। তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি এবং তাদের কেউ মারা গেলে তাকে অনায়াসেই জাহান্নামে পাঠিয়ে দিই। এসব ভাবনা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। উত্তম ও কল্যাণময় চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আলোকিত ব্যক্তি, সমাজ ও পরিবার গঠন করতে হবে। তাহলে সুন্দর ও উন্নত রাষ্ট্র , জাতি প্রতিষ্ঠা সহজ এবং সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ।
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, ধর্ম ও সমাজ সচেতন লেখক, সাংবাদিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক, কুমিল্লা।