বিশ্বের সকল মাতৃভাষাকে ভালবাসতে, পালন করতে এবং সংরক্ষণ করতে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম (১৯৫০-২০১৩) ও তার কয়জন সহযোগী ২১শে ফেব্রুয়ারিকে কানাডায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (IMLD) হিসাবে প্রবর্তনের সফল উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। একুশে একদল বাঙালির আত্মত্যাগের দিন, ১৯৫২ সালের এ দিনে বাংলাভাষা আন্দোলনের সময় বাঙালি তাদের মাতৃভাষার জন্য লড়াই করেছিলেন।
সকল মাতৃভাষাকে সম্মান ও উদযাপন করার জন্য, মি. ইসলাম প্রথম ইউনেস্কোর কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি দিবসটিকে IMLD হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় কানাডাসহ ২৯টি দেশের সঙ্গে, ইউনেস্কো এ দিনটিকে IMLD হিসাবে ঘোষণা প্রদান করে। ২০০০ সাল থেকে, ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সচেতনতা প্রচারের জন্য দিবসটি বিশ্বব্যাপী যথাযোগ্য পালিত হচ্ছে।
কানাডা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাকে ধারণ করে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে তার অসমাপ্ত কাজ রেখে গেছেন সহযোদ্ধাদের জন্য। ১৯৯৯ সালের সে সময়টায় আমি তখন প্যারিসে ২০০৩ সালে কানাডার অভিবাসী হই। মাতৃভাষা দিবসের চেতনাকে সমুন্নত করতে এ কাজের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে কানাডার মানিটোবায় তা উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। ভাষা আন্দোলনে কারাবরণকারী তৎসময়ের মেডিকেল কলেজের ছাত্র (ডাক্তার) ফরিদ উদ্দিন শরীফ এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।
কানাডার আলবার্টা থেকে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ হেরিটেজ এন্ড এথনিক সোসাইটি অব আলবার্টা, ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকওয়ানের সহযোগিতায় কতগুলো যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কানাডার মূলধারার টিভি চ্যানেলগুলোতে বাংলাদেশ ও একুশ ফেব্রুয়ারিকে তুলে ধরার সুযোগ পাই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘হাসিনা: এ ডটারস টেল’ শীর্ষক তথ্যচিত্রে ও বাংলাদেশ হেরিটেজ সোসাইটি অব আলবার্টার সে উদযাপনগুলোর তথ্য ও চিত্র উভয় উঠে এসেছে।
সম্মানিত সৌরভ বড়ুয়া প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিল এস -২৪৭ প্রণয়ন করতে আবেদন শুরু করেন।
আইনটির প্রস্তাবনার তথ্যসূত্রে নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে এর আবেদনময়ীতা, যেমন:
যেখানে ইংরেজি এবং ফরাসি কানাডার অফিসিয়াল ভাষা;
যেখানে কানাডায় ৬০টিরও বেশি বিভিন্ন আদিবাসী ভাষা বলা হয়;
যেখানে কানাডিয়ানরা প্রচুর ভাষায় কথা বলে যা কানাডা এবং এর সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করে;
যেখানে, ১৯৯৯ সালের নভেম্বর, জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থার সাধারণ সম্মেলন দ্বারা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়েছিল;
যেখানে, ২০০৭ সালের মে মাসে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ‘বিশ্বের মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত সমস্ত ভাষার সংরক্ষণ ও সুরক্ষা প্রচার করার জন্য’,
যেখানে কানাডার কিছু প্রদেশ ও শহর ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে স্বীকৃতি দিয়েছে;
এবং যেখানে কানাডার পার্লামেন্ট ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মূল্য স্বীকার করতে চায়;
এখন, তাই, মহামান্য, কানাডার সিনেট এবং হাউস অফ কমন্সের পরামর্শ এবং সম্মতিতে, নিম্নরূপ আইন প্রণয়ন করেন:
এই আইনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আইন হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে...
বহুসংস্কৃতির জাতীয় মূল্যের ঘোষণা হিসাবে বিবেচনা করা হয় কানাডিয়ান চার্টার অফ রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমসের ধারা ২৭কে। ৭০-৮০ এর দশকে কানাডিয়ান সরকারের সরকারি নীতি হিসাবে বহুসংস্কৃতিবাদ গৃহীত হয়েছিল পিয়েরে ইলিয়ট ট্রুডোর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় । বহুসংস্কৃতি কানাডিয়ান পরিচয়ের একটি মূল পার্থক্যকারী উপাদান হিসাবে দেখা হয়। বিশ্বে কিছু ভাষার আধিপত্য থাকায় আদিবাসী মাতৃভাষাগুলোকে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আদিবাসীরা বহু সংখ্যক বিভিন্ন জাতিভাষিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিভক্ত: কানাডার আদিবাসী ভাষাগুলো বিলীন হওয়ার হুমকির মধ্যে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন মানে প্রবাসেও আমাদের কণ্ঠস্বরকে খোঁজার নিরলস প্রচেষ্টা।
এআরএস