পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা দেশীয় সার্বভৌমত্বের সাথে সম্পৃক্ত

ড. জান্নাতুল ফেরদৌস প্রকাশিত: জুন ২৭, ২০২৩, ০৭:১৪ পিএম
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা দেশীয় সার্বভৌমত্বের সাথে সম্পৃক্ত

অশান্ত পাহাড়ি অঞ্চলে ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে সংঘাত দেখা গেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এসকল বিষয়ে সরকারের একাধিক উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতীতের তুলনায় ক্রমেই পাহাড় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।  

এরমধ্যে গত এপ্রিলের শুরুতে রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের খামতাংপাড়া এলাকায় একসঙ্গে ৮টি লাশের খবর পাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জানিয়েছেন, পাহাড়ের দুই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) মধ্যে গোলাগুলিতে এ ঘটনা ঘটে। তবে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের দায়িত্বশীলরা বলছেন, কেএনএফের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটেছে।

তবে সময়ে সময়ে পাহাড়ের উত্তেজনা আমাদের চাপা উৎকন্ঠা বাড়িয়ে দেয়। অনেকটা একটি দেহের অঙ্গে ব্যথার মত। ভাবতে বাধ্য করে, তাহলে পাহাড়ের এ সমস্যা নিরসন হবে কবে? ২৫ বছর পার হলো তবুও আমরা নিরাপদ পাহাড় তৈরী করতে পারিনি। একটু গভীরে যাওয়া যাক।

২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যা ১৮ লাখ ৪২ হাজার ৮১৫, যার মধ্যে ৪৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ উপজাতি এবং ৫০ দশমিক ০৬ শতাংশ বাঙালি। স্বাক্ষরতার হার ৬৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। উপজাতীয়দের মধ্যে চাকমা উপজাতি ৭৩ শতাংশ শিক্ষার হার নিয়ে অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর চেয়ে এগিয়ে। ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে উপজাতীয়দের মধ্যে চাকমাদের প্রভাব অনেক বেশি পরিলক্ষিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস আমরা কমবেশি সবাই জানি। সংঘাতের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে দেখা যায়, ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এমএন লারমা ও কতিপয় উপজাতীয় নেতা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) গঠন এবং জুম্মল্যান্ড নামে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে ধরেন।

তবে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও জাতীয় সংহতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তৎকালীন সরকার তাদের ওইসব দাবি সঙ্গত কারণেই মেনে নেয়নি। এক পর্যায়ে সংগঠনটি প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি পিসিজেএসএসএর সামরিক শাখা শান্তি বাহিনী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করে।

১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অমরপুর এলাকার কল্যাণপুর নামক স্থানে শান্তি বাহিনীর ক্যাম্পে প্রীতি গ্র“পের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষে পিসিজেএসএস এর সভাপতি এমএন লারমা নিহত হয়। পরবর্তীতে, সন্তু লারমা পিসিজেএসএস এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মূলত ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি থেকে শান্তি বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত সংঘটিত হতে থাকে। এছাড়া ‘শান্তি বাহিনী’ কর্তৃক হত্যা, অপহরণ, গুম, জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টি এবং পুনর্বাসিত বাঙালিদের উপর নৃশংস হামলার ঘটনার পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।

সংকট নিরসনে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর অশান্ত-অস্থির পার্বত্য তিন জেলার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিরসনে তৎকালীন সরকার কতৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে শান্তি চুক্তি করা হয়। যা পরবর্তীতে পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামে পরিচিতি পায়।

শান্তিপূর্ণ ও উন্নত পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠনের লক্ষ্যে অশান্ত-অস্থির পার্বত্য জেলাসমূহকে (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা নিরসন হয়। বন্ধ হয় দীর্ঘদিন চলা পার্বত্য অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত। নিজ দেশের অখন্ডতা রক্ষায় বঙ্গবন্ধু কন্যার এই চুক্তি ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে অগ্রগণ্য। এই শান্তি চুক্তি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত হয় এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সাথে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিও বৃদ্ধি পায়।

চুক্তির অংশ হিসেবে ৩৩টি বিভাগের মধ্যে ৩০টি বিভাগ ইতোমধ্যে জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ এবং ১৫টি আংশিক বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

এছাড়া ০৯টি ধারা বাস্তবায়নের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের মাধ্যমে ১২হাজার ২২৩টি উপজাতি পরিবারের ৬৪ হাজার ৬১২ জন ভারত প্রত্যাগত উপজাতি শরণার্থীর পুনর্বাসন সম্পন্ন করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পর ৮১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪০৪টি উচ্চ বিদ্যালয়, ২৫টি কলেজ, ১১টি পলিট্যাকনিক ইন্সষ্টিটিউট, ১টি নার্সিং ইন্সষ্টিটিউট, ৩টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ¡বিদ্যালয় এবং ১টি মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়েছে।

বান্দরবানের থানচি ও রুমা সেতু এবং খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়ে বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী সেতু, সীমান্ত সড়ক নির্মাণসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পর ৩ হাজার ৪৪০ কিঃমিঃ সড়ক, ৩২টি হাসপাতাল ও ২৭টি শিল্প/কলকারখানা স্থাপিত হয়েছে। চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ব্রিগেড ও ২৪১টি ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ৬৯টি নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।

কিন্তু বাস্তবিক অর্থে পাহাড়ি জনপদ এখনও নিরাপদ নয়। বিশৃঙ্খলা নিয়মিত ঘটেছে। এর কারন হিসেবে কিছু বিষয় আমাদের সামনে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যেগুলো সমাধান করাও জরুরি। এরমধ্যে-

শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে সরকারের সাথে এই চুক্তি হয়েছিল, তাদের দাবি-চুক্তির অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যেসব এখনও হয়নি সেগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। যদিও বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের গতি ধীর। ফলে সমস্যা নিরসন সম্ভব হচ্ছে না।

আঞ্চলিক ও পার্বত্য পরিষদের নির্বাচন
শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৭ সালের পরের বছরই গঠিত হয়েছিল আঞ্চলিক পরিষদ। এবং বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি- এই তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। তবে তারপরে গত দুই দশকে এসব পরিষদের নির্বাচন না হওয়া পাহড়িদের অসন্তোষের আরেকটি কারণ হিসেবে বিবেচিত। শুরুতে যাদেরকে সেসব পরিষদে বসানো হয়েছিল তারাই এখনও এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এমনকি স্থানীয় নাগরিকদের ভোটার তালিকা প্রস্তুতি নিয়েও বিভিন্ন সময়ে কথা উঠেছে।

ভূমি সমস্যা
পার্বত্য চট্টগ্রামে জমির মালিকানা নিয়ে পাহাড়িদের বেশকিছু অভিযোগ রয়েছে। পাহাড়িরা বৃটিশ ভারতের আইন রক্ষায় প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ব্রিটিশ আমলের সেসব আইন অনুসারে ভূমির মালিকানা সেখানে বসবাসরত পাহাড়ি মানুষের। কিন্তু এসব ভূমির মালিকানার কোন দলিলপত্র নেই তাদের কাছে। আবার পরে বাঙালিদের বসতি গড়ে ওঠার পর মালিকানার বিরোধ এখন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু উভয়পক্ষের মধ্যে মৌলিক কোন সমোঝোতা দেখা যায়নি।

পাহাড়িদের বিভেদ
শান্তিচুক্তি হওয়ার পর থেকে গত ২০ বছর পাহাড়িদের সংগঠনগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায়শই সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায় এবং তাতে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি গত এপ্রিলে ৮ জন খুনের ঘটনা সেই বিভেদেরই অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের মাঝে মতৈক্যে পৌছানো কঠিন হয়ে পড়ে।

বাঙালিদের বসতি ও অবিশ্বাস
পাহাড়িদের আরেকটি বড় সঙ্কটের দিক হলো তারা বিশ্বাস করেন, বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী তাদের উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে তাদের এই অবিশ্বাস এবং ভয় কাটানোর জন্য তেমন কোন জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

পিছিয়ে পড়া উন্নয়ন ও দুর্গম এলাকা
অনেকেই বলেন, সারা দেশে যেভাবে উন্নয়ন হয়েছে সেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন হয়নি। দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে উন্নয়নের জন্যে সেখানে যে বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা ছিল সেরকমও হয়নি।

অস্থিরতার পেছনে আরো একটি কারণ হচ্ছে এর ভৌগলিক অবস্থান। প্রত্যন্ত, দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকা হওয়ার কারণে নিরাপত্তা বাহিনী খুব দ্রুত ও সহজে সেখানে পৌঁছাতে পারে না। গত কয়েক বছরে ওই এলাকায় অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন সেতুও, বিশেষ করে বান্দরবানে। সাজেকের মতো দুর্গম এলাকাতেও তৈরি হয়েছে পর্যটন কেন্দ্র।

কাজেই, পার্বত্য জনপদের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার সাথে জড়িত। আঞ্চলিক ক্ষুদ্র বা স্বীয় স্বার্থের উর্ধে উঠে সকল আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষিত সমাজ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবি, ধর্মীয় নেতাসহ সকল সচেতন নাগরিকের সচেষ্ট ভূমিকার পাশাপাশি আঞ্চলিক জনপদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।

প্রত্যেকের একটাই লক্ষ্য হওয়া দরকার কিভাবে সবাই সবার সাথে হাত মিলিয়ে এ অঞ্চলের অবকাঠামোগত, সামাজিক, পরিবেশগত, প্রশাসনিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন করার মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌম রক্ষা করতে পারে। তবেই পার্বত্য অঞ্চলের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকা তথা আমাদের সামগ্রিক সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে।

লেখক:  সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়