আমাদের সমাজে এখনও শিশুরা বাসাবাড়ি, হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকানপাট, বিভিন্ন যানবাহনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। অথচ কোমলমতি এসব শিশুদের এসময়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিশ্চিত এবং অন্নবস্ত্র, বাসস্থান, সুচিকিৎসার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের গন্ডিতে সহপাঠীদের সাথে শৈশব উপভোগে খেলাধুলায় মত্য থাকার কথা।
কখনও কি আমরা ভেবেছি, এই শিশুরা পড়ালেখা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান ও অন্নবস্ত্রের নিশ্চয়তা না পেয়ে কীভাবে বেড়ে উঠছে? কিন্তু শিশুদের এসব অধিকার নিশ্চিত করা দূরে থাক, আমাদের এ নিষ্ঠুর সমাজে তাদের প্রকাশ্যে পিটিয়ে, ছেঁকা দিয়ে, এমনকি নিভৃত ঘরে বন্দী করে রেখে দানা-পানি না দিয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার মতো অমানবিক ঘটনা ঘটছে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর আরও অনেক দেশে।
এমন অবহেলা সামাজিকভাবে কতবড় লজ্জাজনক তা ভাবলে শিউরে ওঠা ব্যতীত কোনও করণীয় থাকে না অনেকেরই। কিন্তু এমন পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিশুদের রক্ষা করা খুব জরুরি। আমাদের ভবিষ্যত নির্ধারণে তাদের অংশগ্রহণ জরুরি। তাদের সুরক্ষায় বিবেচনায় জাতীয় বরাদ্দ নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণার বহু পূর্বে ১৯৭৪ সালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ শিশু আইন প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধু কণ্যা শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সরকার জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ এবং শিশু আইন ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। পথশিশু, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
শিশুদের মানবাধিকার এবং সকল শিশুর জন্য যেসব অধিকার অর্জন করতে হলে সব দেশের সরকারকে যে নিরিখগুলো অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে সেগুলো খুব সংক্ষেপে অথচ সম্পূর্ণভাবে বিবৃত হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে : এটি হচ্ছে শিশু অধিকার সনদ। এ সনদ ইতিহাসের সবচেয়ে সর্বজনীন মানবাধিকার দলিল। তাই এ দলিল মানবাধিকারের সর্বজনীন প্রয়োগ অন্বেষায় অনন্যভাবে শিশুদেরকে মধ্যমণি করে তুলেছে। দলিলটি অনুমোদনের মাধ্যমে জাতীয় সরকারগুলো শিশুদের অধিকার রক্ষা ও নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে এবং এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের দায়বদ্ধ করে তুলেছে।
কিন্তু তবুও আমাদের এই উন্নয়নশীল বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি যেখানে শিশু। আমাদের দায়বদ্ধতা সার্বিকভাবে এবং সামাজিকভাবে অপরিসীম। কারণ এং ৪০ শতাংশ শিশুর মধ্যে ১৫ শতাংশের বেশি দরিদ্র সীমারেখার নিচে বসবাস করে। এই দরিদ্র শিশুদের মধ্যে রয়েছে শ্রমজীবী শিশু, গৃহকর্ম ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, পথশিশু, বাল্যবিবাহের শিকার শিশু এবং চর, পাহাড় আর দুর্গম এলাকায় বসবাসরত শিশু। আমরা যখন ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা বলি, তখন এই প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কী ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করছি, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেননা, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোনো রকম টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে ও মাদককে চিরতরে বিতাড়িত করতে হবো। যৌন হয়রানি ও অশিক্ষাকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজ, পরিবার ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অভিভাবকের সচেতনতা শিশু অধিকার রক্ষার পূর্বশর্ত। শিশু অধিকার একটি বহুমুখী ধারণা। যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও অধিকার লংঘন থেকে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা একটি অপরিহার্য সামাজিক কর্তব্য। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করায় আমাদের শিশুদের একটি বিশাল সংখ্যা বেড়ে উঠছে দারিদ্র্যের ভেতর। এ শিশুরা অধিকার ও প্রয়োজনীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত। গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মা ও শিশু অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মায়ের অধিকার সুরক্ষা হলে, শিশুর অধিকার অনেকাংশে রক্ষা পায়।
একজন গর্ভবতী মা গর্ভাবস্থায় তার অধিকারগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে পেলে, জন্মের আগে থেকেই অনাগত শিশু ও তার অধিকার ও সুরক্ষা পেয়ে যায়। তাই শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তা সুরক্ষায় সবার আগে পরিবারটিকেই কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিপর্যায়ে শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। নিরাপত্তা, বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ রাষ্ট্র স্বীকৃত সকল অধিকার এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। আর সেগুলো হতে হবে বৈষম্যহীন। অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, লিঙ্গ, গোত্র, শারীরিক কোনো শ্রেণিভেদে শিশুদের বিভাজন করা যাবে না। এসব পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন হলেই একজন শিশু সঠিকভাবে বেড়ে উঠবে। যে শিশুটি হবে আমাদের আগামীর কর্ণধার।
শিশু অধিকার বাস্তবায়নে আসলে আমাদের করণীয় কী? এই করণীয় নির্ধারণে প্রথমে আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নজর দেয়া জরুরি। বাংলাদেশ শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে আইনকানুন ও নীতি প্রণয়নে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে। আমাদের শিশুনীতি, শিশু আইন, শিশুশ্রম নিরসন নীতি, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পাচার প্রতিরোধসহ নানা বিষয়ে শিশুদের সুরক্ষামূলক আইন রয়েছে, যা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় একটি দুর্বলতা হলো, এসব প্রতিষ্ঠানের কাজের সমন্বয়ের জন্য দায়িত্বশীল কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বাংলাদেশে কর্মরত শিশু অধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের জন্য একটি পৃথক অধিদপ্তরের দাবি জানিয়ে আসছে, যা জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটিও সুপারিশ করেছে, কিন্তু তার বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ে না। সাম্প্রতিক সময়ে শিশুর ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন যে হারে বেড়েছে, তার প্রতিকারে অনেক আইনি বিধান থাকলেও এই ধরনের কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য আমরা বেশি কিছু করতে পারছি না। এই সমস্যার মূলে রয়েছে আমাদের জাতীয় এবং সামাজিকভাবে কোনো সমন্বিত শিশু সুরক্ষা কাঠামো না থাকা।
শিশুর প্রতি কেন পৈশাচিক আচরণ? কেন এ বর্বরতা? এ প্রশ্ন আজ সবার। মানুষের যৌন লালসা, অভিজাত শ্রেণীর অনেকের বিলাসী মনোভাব ও অতি অধিকার চর্চায় আজকের শিশু চরম নিষ্ঠুরতার শিকার। শিশুর প্রতি বিরূপ আচরণ বিবেকহীন মানুষের অসুস্থ মানসিকতার প্রকাশ। বিকৃত মানসিকতা। যা অসুস্থ সমাজের বহিঃপ্রকাশ।
কিন্তু সময় এসেছে পরিবর্তনের। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের সঠিক বিকাশ এবং পুষ্টি নিশ্চয়তা থেকে শুরু করে সার্বিকভাবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
শিশুরা চায় চারপাশের মানুষজন তাদের ভালোবাসা ও স্নেহের পরশ দেবে। একটি সুন্দর নিরাপদ আশ্রয় দেবে। কিন্তু আমাদের সমাজের দৃশ্যপট ভিন্ন। দারিদ্র্যের কারণে কাজ করতে বাধ্য হয় শিশু। অনেক সময় নিয়োগকারীর হাতে নিপীড়ন-যৌন হয়রানির শিকার হয় কর্মজীবী শিশু। গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর হাতে শিশু শারীরিক নির্যাতন ও যৌনাচারের শিকার হচ্ছে। শিশু নির্যাতনকারী অনেকে অভিজাত। এমনকি শিশু অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন সেসকল দায়িত্বশীল মানুষদের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ অহরহ আসতে দেখা যায়।
দেশে বিরাজমান আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে শিশুর বিকাশ বহু ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে সবাইকে হতে হবে সংবেদনশীল। শিশুর গর্ভকালীন পরিচর্যা, অসুস্থতা, অপুষ্টি, শারীরিক ত্রুটি, দুর্ঘটনা, অস্বাভাবিক শারীরিক গঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষত সতর্ক থাকতে হবে প্রতিবন্ধী শিশুর ক্ষেত্রে। দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার রক্ষায় সবাইকে যত্নবান হতে হবে। শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশে তাদের প্রতি বঞ্চনা, অবহেলা ও ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না। নজর দিতে হবে শিশুর দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা ও ভীতির কারণ সম্পর্কে। আবার শিশুর প্রতি অতিস্নেহ, ভালোবাসা, অতি শাসন, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, শাস্তি ও সমালোচনা প্রভৃতি বিষয়ে বিরত থাকতে হবে। অতি নিয়ন্ত্রণে শিশুরা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কা প্রবল। এ পরিপ্রেক্ষিতে অভিভাবক মহলকে শিশুর সুরক্ষায় কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে।
একটি জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। যদিও এই হার বর্তমান সরকারের আমলে এখন অনেকটা কমতে শুরু করেছে। জরিপে দেখা যায়, দরিদ্র পরিবারের অন্তত ৪০ শতাংশ শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। তবে রাষ্ট্রের একার পক্ষে সম্ভব নয় সব শিশুর দায়-দায়িত্ব নেয়ার। প্রয়োজন সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। শিশু অধিকার রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন আইন রয়েছে। এগুলো প্রয়োগে আরও কঠোর হতে হবে। দেশের সব শিশুকে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করার জন্য সরকার, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
সর্বোপরি বিশেষ কতগুলো দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। এরমধ্যে নবজাতকের জীবন সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, শিশুর জীবন রক্ষায় পরিচ্ছন্নতা, সময়মতো জন্ম নিবন্ধন, শিশুর সঠিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করা, শৈশবের পরিচর্যা ও বিকাশ, মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা, শিশুর ওপর সহিংসতা রোধ, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণ, বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা। এসকল বিষয়ে সচেতন দৃষ্টি দেয়ার নিমিত্তে সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আগামীর ভবিষ্যত সুরক্ষা সহজতর হবে।
লেখক: ড. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]
আরএস