চাল হলো বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতের বেশিরভাগ মানুষের প্রধান খাদ্য। বাংলাদেশের জন্য কৃষি খাত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগত খাত।
খাদ্য ছাড়া, বিশৃঙ্খলা এবং দেউলিয়া হতে পারে। তাই বাংলাদেশ সরকার চালের প্রাপ্যতা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। যদি দেশে চালের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ঘাটতি থাকে তাহলে সরকার চাল আমদানি করে বা করার অনুমতি দেয়।
বাংলাদেশের কৃষি খাত অন্যতম সেরা খাত হলেও আমরা চাল আমদানি করি, যাতে চালের ঘাটতি না হয়, কারণ বাংলাদেশের মানুষের জীবনে চাল একটি অপরিহার্য পণ্য। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘চালের কূটনীতি’ বিষয়টি আছে। ভারতে বিভিন্ন স্থানে জুলাইয়ের শুরুতে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ধানের ক্ষেত গুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাই ২০শে জুলাই ভারত সরকার যৌক্তিক মূল্যে তাদের জনগণ যাতে চাল পায়, তার পর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে বাসমতি ছাড়া সাদা চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। গত বছরও তারা একই কারণে, সব ধরণের চালের উপর রপ্তানি শুল্ক ধার্য্য করেছিল এবং চাল রপ্তানি বন্ধ করে ছিল।
ভারতের নীতিনির্ধারকেরা আশা করছেন রপ্তানি বন্ধ রাখার ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম কমে যাবে, যা গত বছরে প্রায় ১২% বেড়েছে। কিন্তু বাকি বিশ্বের কি হবে? ভারত বিশ্বের বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক, বিশ্ব বাণিজ্যের ৪০% চাল ভারত থেকে রপ্তানি হয়। ২০২২ সালে ভারত ১৪০ টিরও বেশি দেশে ২২ মিলিয়ন টন চাল রপ্তানি করেছে। চাল ব্যবসায়ীদের মতে ভারত থেকে চাল সরবরাহ কমে গেলে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
ভারতের চাল-রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কী হবে? বিশ্বব্যাপী চালের দাম বাড়বে এবং দরিদ্র দেশগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বেনিন, বাংলাদেশ, অ্যাঙ্গোলা, ক্যামেরুন, জিবুতি, গিনি, আইভরি কোস্ট, কেনিয়া এবং নেপালের মতন দেশ গুলোতেও চাল একটি প্রধান খাদ্য এবং বাসমতি ছাড়া অন্য জাতের ভারতীয় চালের প্রধান ক্রেতা। আবার ইরান, ইরাক এবং সৌদি আরব ভারত থেকে বাসমতি চাল কিনে। ভারতের চাল রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী সংকট সৃষ্টি করতে পারে। ভারত হল বিশ্বের শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক: ভারত ২০২২ সালে রেকর্ড ২২ মিলিয়ন টন চাল রপ্তানি করেছে, যা বিশ্বের ৫৫.৪ মিলিয়ন টন বৈশ্বিক চাল রপ্তানির ৪০% এরও বেশি।
তবে বাংলাদেশের দেশীয় বাজার ভারতের চাল-রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে প্রভাবিত নাও হতে পারে। কারণ বাংলাদেশে রর্তমানে পাবলিক স্টোরেজে পর্যাপ্ত চাল মজুদ। গত দুই ফসলের মৌসুমে ভালো ফসলের কারণে ভারতের চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করার কারণে বাংলাদেশের জন্য তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে চালের ভালো মজুদ আছে এবং দেশীয় উৎপাদন ভালো । খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে ১২ জুলাই পর্যন্ত ১৯ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত ছিল। এটি এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ পরিমাণ খাদ্য মজুদ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শুষ্ক বোরো মৌসুমের ধানের হিসাব বিবেচনা করলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট উৎপাদন ৫ শতাংশ বেড়ে ৮ কোটি টন হতে পারে। ডিএই অনুমান করছে বাংলাদেশের বোরো উৎপাদন ২.১৮ কোটি টন হতে পারে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ এবং গড় বছর উৎপাদনের ৮ শতাংশ বেশি। কৃষকদের ফলন ভালো হয়েছে। সুতরাং এখন বাংলাদেশে চালের দাম বাড়ার সম্ভাবনা নেই। এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশে চালের আমদানি শুল্ক এখন প্রায় ৬২ শতাংশ। এই হারে কেউ চাল আমদানি করবে না কারণ আমদানিকৃত চাল এই শুল্কে প্রতিযোগিতামূলক হবে না। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ বছরে ৭ শতাংশ বেশি চাল আমদানি করেছে, মোট ১০.৫৫ লাখ টন। বেসরকারী আমদানিকারকরা ৪২১০০০ টন আমদানি করেছে।
চাল ও গম সরবরাহের বিষয়ে এখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো চুক্তি নেই। অভ্যন্তরীণ বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকায় খুচরা বাজারে চালের দাম বর্তমানে স্থিতিশীল এবং সরকার এই সময়ে চাল আমদানির কথা ভাবছে না। দেশে বর্তমানে ১৬ লাখ ১৯ হাজার টন চাল মজুদ রয়েছে। সরকারও বোরো ধান ও চাল কেনার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশে চালের আমদানির ওপর নির্ভর করতে হবে না, তাই আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি স্থানীয় বাজারে তেমন প্রভাব ফেলবে না। বাংলাদেশ এ বছর আমন ধানের বাম্পার ফলনের আশা করছে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনের মৌসুমে আমন উৎপাদন হয় প্রায় ১.৫ কোটি টন। আমন ফসলের জন্য বৃষ্টিপাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সাম্প্রতিক মাসগুলিতে তা অস্বাভাবিকভাবে কম হলেও, গত ২০ দিনে দেশে নিয়মিত বৃষ্টি হয়েছে। এতে আমনের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাজারে চালের দাম ছিল নিম্নরূপ: মোটা জাতের চাল সরনা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা, বিআর২৮ এবং বিআর২৯ প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা, মিনিকেট চাল প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৬৮ টাকা এবং নাজিরশাইল সূক্ষ্ম জাতের চাল ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজিতে, কাজল লতা চাল প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৬২ টাকায়, স্থানীয় বাসমতি চাল ৮০ টাকা কেজি এবং পাইজাম চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে।
তাছাড়াও চাল বাণিজ্য নিয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী মিয়ানমার বাংলাদেশে দুই লাখ টন সাদা চাল রপ্তানি করবে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমার সরাসরি বাংলাদেশে ২,৬৫০ টন চাল পাঠাবে। মিয়ানমারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সরকার-টু-সরকার চুক্তি অনুযায়ী, মিয়ানমার দেড় লাখ টন সাদা চাল পাঠিয়েছে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশ ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর চাল বাণিজ্যের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২২ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে মিয়ানমারের কাছ থেকে ২৫০,০০০ টন সাদা চাল এবং ৫০,০০০ টন সিদ্ধ চাল কিনতে সম্মত হয়েছে। চাল বাণিজ্যে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, মিয়ানমার রাইস ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে ৪৮টি কোম্পানি ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে চীনা ইউয়ান দিয়ে বাংলাদেশে ২০০,০০০ টন চাল রপ্তানি করবে। চুক্তির আওতায় সাদা চাল (ATAP) GPCT Broken STX জাতের ধান সরবরাহ করা হবে। এফওবি মূল্য ছিল ২.৭৮৮৫৬ ইউয়ান প্রতি কিলোগ্রাম এবং ২৮৮.৫৬ ইউয়ান প্রতি টন।
লেখক: কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
এআরএস