দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাতে হারাতে প্রবলরকম আস্থাহীনতার সংকটে পড়ছে দেশের প্রায় সব শ্রেণির গণমাধ্যম। পাঠক, ভিউয়ার বা অডিয়েন্সের আস্থা যে হারে কমছে ঠিক একইহারে বেড়েছে ‘আমজনতা’র ক্ষোভ, রাগ, অভিমান। আগের মতো সামাজিক মর্যাদা পাচ্ছেন না সংবাদকর্মীরা। উল্টো সংবাদ প্রকাশের জেরে হামলা, মামলার শিকার হয়ে প্রতিদিন প্রাণের ঝুঁকিতে পড়ছেন। যদিও শুধু আস্থাহীনতার বিপদই নয়, বিজ্ঞাপনের বাজার ভাগাভাগির কারণে রাজস্ব আয় বিপজ্জনকহারে কমে গিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হয়েছে।
বেশিরভাগ গণমাধ্যম অবাস্তব প্রচার সংখ্যা দেখিয়ে বিজ্ঞাপনের বেশি রেট বাগিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করলেও বঞ্চিত করা হচ্ছে সংবাদকর্মীদের। মূলত, দুর্নীতি আর রাজনৈতিক বিশেষ বিজ্ঞাপনী সুবিধা নিয়ে গণমাধ্যমের ফাঁপা বিজনেস মডেল বছরের পর বছর ধরে সংবাদমাধ্যমকে শিল্প হিসেবে দাঁড়াতেই দিচ্ছে না। এর মধ্যে শুধু হাতে গোনা দু’একটি ‘পাঠকপ্রিয়’ গণমাধ্যম বেসরকারি বিজ্ঞাপনের বড় বাজার একচেটিয়াভাবে দখলে রেখে বেশি আয় করছে। জনমুখী সাংবাদিকতার জন্য যুদ্ধ করে টিকেও থাকছে।
গণমাধ্যমের ওপর এই আস্থাহীনতার বিপদের পেছনে অনেকে গোষ্ঠী বা ব্যক্তিস্বার্থের সম্পাদকীয় নীতিকেই দায়ী করছেন। বলা হচ্ছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সম্পাদকীয় বা বার্তাপ্রধান বা বিনিয়োগকারীদের প্রায় শতভাগই প্রবলরকম রাজনীতি প্রভাবিত। অতীতে কোনো না কোনো দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা বা কর্মীর ভূমিকায় রাজপথ কাঁপিয়েছেন তারা। এমনকি বর্তমানেও অনেকে বিভিন্ন পদে থেকে নিজ নিজ দলকে গভীর সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। যাদের প্রায় সবাই নিজ নিজ দলীয়প্রধানসহ উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের প্রশ্নহীনচিত্তে মান্য করেন।
গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের এই ‘অতিরাজনীতি প্রবণতা’র প্রমাণ মেলে তাদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যমে। রাজপথে দু’দলের মিছিল, হামলা, সংঘাত-প্রাণহানি হলেই সেখানে রাজনীতির উৎসবমুখরতা খুঁজে পায় রাজনীতিপ্রবণ গণমাধ্যমগুলো। আট কলামে লিডও হয়। টকশোগুলো রাতদিন মুখর থাকে সেগুলোর বস্তাপচা বিশ্লেষণ নিয়ে। অথচ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে অসহনীয় জীবন, মূল্যস্ফীতির অভিঘাত, কর্মসংস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বেহাল দশা, তারুণ্যের অপচয় নিয়ে কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা যায় না।
গণমাধ্যমে যতটা গুরুত্ব পান মননে-মগজে পচনধরা সেকেলে দৃষ্টিভঙ্গির পাতি নেতারা, ততটা পান না নিজেদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে রাজপথে নামা উচ্চশিক্ষিত তরুণরা। অথচ, দশকের পর দশক ধরে অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা, দিক নির্দেশনায় গণমাধ্যমগুলো লাখ লাখ ঘণ্টা ব্যয় করেও রাজনীতির কোয়ালিটি বাড়াতে পারেনি। বরং সংবাদমাধ্যমের রাজনীতিমুখী নীতিনির্ধারকরা ‘অপরাজনীতি’কে প্রমোট করে গেছেন আদর্শের অঙ্গীকারে। যা এখন গভীরভাবে জেঁকে বসেছে সমাজে, রাষ্ট্রে, সরকারে।
সমাজে মূল্যবোধের পচন, উন্নত রুচির শিক্ষিত, মার্জিত মানুষ তৈরি নিয়ে যতটা না ভাবে গণমাধ্যম, তারচেয়ে বেশি মনোযোগ অপরাজনীতি আর উন্নয়নের রাজনৈতিক দর্শনকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার বিষয়টিতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা আর উদ্ভাবনের মূলকেন্দ্র বানানোর বদলে ‘অপরাজনীতির’ আখড়ায় পরিণত করা হয়েছে। আর গণমাধ্যম থেকে বিজ্ঞানচর্চা, গবেষণা, উদ্ভাবন সংশ্লিষ্ট পাতাগুলো অপসারণ করে অন্ধবিশ্বাসভিত্তিক জ্ঞানের দরজা উন্মুক্ত করা হয়েছে।
প্রায় তিন-চার দশক আগে গণমাধ্যমের এমন রাজনৈতিকপ্রবণতা সময়ের দাবিতে অনিবার্য হিসেবে ধরে নেয়া হলেও বর্তমান বাস্তবতায় বিষয়টি বিপজ্জনক। বিদ্যমান ‘অপরাজনীতি’ আর স্বেচ্ছাচারিতার প্রতি প্রশ্নহীনতা, অতীতমুখী মুখস্থ, একঘেঁয়ে বয়ানের কারণেই মূলত গণমাধ্যমের ওপর গণআস্থা ভয়াবহভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম তথা সংবাদমাধ্যম পরিণত হয়েছে রাজনীতির প্রচারমাধ্যম বা রাজমাধ্যমে।
(গণমাধ্যম ভাবনা: ১ অক্টোবর, ২০২৩। এলিফেন্ট রোড, ঢাকা)