রাজধানী ঢাকায় নাগরিকের ভোগান্তির যেন শেষ নেই। যানজট এখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে পড়েছে এখানে। সকাল থেকেই ক্রমে সড়কে গাড়ির চাপ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে অলি-গলিতে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। কার্যত অচল হয়ে পড়ে রাজধানীর সড়ক। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ।
একটি জরিপের উঠে আসে, রাজধানীতে ৫৩ শতাংশ যাত্রী গণপরিবহন ব্যবহার করেন। ১১ শতাংশ যাত্রী ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত গাড়ি। অথচ এসকল গাড়িই ৭০ শতাংশ রাস্তা ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে। ঢাকায় মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ আর রিক্সার তো কোনো সুনির্দিষ্ট হিসেবই নেই।
সড়কের নিরাপত্তা ও সুশৃঙ্খল ট্রাফিক নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণে ফ্লাইওভার, ওভারপাস, ইউলুপ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। তারপরও যানজট কমছে না বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বেড়ছে। কারণ এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মাত্রায় স্টাডি করা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় যে পরিমাণে মানুষের চাপ বাড়ছে, তাতে মেট্রোরেল ও সাবওয়ে যানজট কমাতে পারবে না। মেট্রোরেল ও সাবওয়েতে কয়েক লাখ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের সঙ্গে আর মাত্র ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকার পুরোনো বাস প্রত্যাহার করে চার হাজার আধুনিক নতুন বাস এসি, নন এসি ও সাধারণ তিন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে রুট ফ্রাঞ্চাইজি পদ্ধতিতে পরিচালনা করলে এবং বাসের জন্য আলাদা লেন ব্যবস্থা করলে প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহারকারীরা বাসে চলাচল করতে পারতেন।
ঢাকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজস্ব বাস সার্ভিস বাধ্যতামূলক করার দাবি তুলেছেন অনেকেই। এটিও এখন অন্যতম ফেক্টর। প্রয়োজনে বাস ক্রয়ে সরকারি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার কমবে। বাইসাইকেল লেন তৈরি করলে কয়েক লাখ ছাত্র-যুবক বাইসাইকেলে যাতায়াত করতে পারবেন। এসব উদ্যোগ গ্রহণ করলে রাজধানীর যানজট কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশা করা যায়।
যানজট কমলে ঢাকায় মোটরসাইকেল ব্যবহার ব্যাপকভাবে কমবে। একই সঙ্গে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও মফস্বল শহরকেন্দ্রিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করলে ঢাকামুখী জনস্রোতও কমে আসবে। এসব সমন্বিত ও টেকসই উদ্যোগের ফলে রাজধানীর যানজট ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেলে দেশে অর্থনৈতিক আরও বেগবান হবে।
সড়ক পরিবহনে বিশৃঙ্খলার পেঁছনে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী রয়েছে, যারা নানা অজুহাতে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করতে দিচ্ছে না। এই খাতে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির বিরাট সুযোগ থাকায় গোষ্ঠীটি হীনস্বার্থে সড়ক পরিবহন খাতে অব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রাখছে। সমস্যাটি রাজনৈতিক হওয়ায় যখন যে দল ক্ষমতাসীন থাকে, তখন সেই দলের লোকজন সড়ক পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চাঁদাবাজি করে বেড়ায়। সড়ক পরিবহন খাতে চাঁদাবাজিকে অচিরেই নিষিদ্ধ করতে হবে।
এ ছাড়াও দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে। চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে। বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য সার্ভিস রোড তৈরি করতে হবে। পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে। গণপরিবহনে চাঁদাবাজি শতভাগ বন্ধ করতে হবে। রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে। টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। সড়ক পরিবহন আইন বাধাহীন বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমরা মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি। দেশের রাজধানীতে ঢাকা আমাদের মূল প্রাণকেন্দ্র। ঢাকাকে আরও গতিশীল, সতেজ, সবুজ ও প্রশান্তিদায়ক করে গড়ে তুলতে সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা চালানো উচিত বলে মনে করছি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে একটু একটু করে আমরা পরিবর্তন দেখতে পারবো। সুশৃঙ্খল ঢাকার স্বপ্ন দেখি প্রতিনিয়ত। আসুন রাজধানী ঢাকাকে প্রশান্তির ঢাকা হিসেবে গড়ে তুলি।
লেখক, তরুণ গবেষক ও সাংবাদিক