বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আইকন। তার দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশের উন্নতি ও উন্নত সমাজের জন্য নারীর সশক্তিকরণে ও ক্ষমতায়নে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি তার কার্যকালের একটি বিশেষ লক্ষ্য হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষ এখন সরকারের যেকোনো ইতিবাচক পরিকল্পনা ও কর্মসূচিকে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্য বলে মনে করে। ফলে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সহজ হচ্ছে। এটি একসময় সম্ভব ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে প্রযুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার মাধ্যমে বাস্তবধর্মী কর্মপরিকল্পনার সূচনা করেন। যেটা ডিজিটাল ধারণা বলে অভিহিত।
২০১০ থেকে ২০২১ সালের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনায় দুটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫) ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬-২০২১) বাস্তবায়নের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নের যুগপৎ যাত্রা শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু রাজনীতিবিদ নন, তিনি একজন প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদও বটে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন যাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। যার ফলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৪১তম অর্থনীতির দেশ। বিশ্বের কাছে যা উন্নয়নের এক বিস্ময়। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একটি নিরবচ্ছিন্ন এবং কার্যকর যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি যমুনা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে জাপান সফরকালে যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য তিনি জাপান সরকারের সহায়তা চান।
এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয় এবং ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই সেতুর উদ্বোধন করেন। আর বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন অভিযাত্রায় এবার বিশ্বের কাছে বিস্ময় জাগানো আরও একটি মাইলফলক যোগ হয়েছে ২৫ জুন পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে। শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বে সাড়া জাগানো এই নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছেন। সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রেখে এবং সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের দরিদ্রতম দশটি দেশের একটি। ৮৮ শতাংশ মানুষ ছিল দরিদ্র। বৈদেশিক সাহায্যের নির্ভরতাও ছিল ৮৮ ভাগ। বাংলাদেশ টিকে থাকবে কি না, এ নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে শূন্য হাতে সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন।
প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) প্রণয়নের দ্বিতীয় বছরে ১৯৭৪-৭৫ সালে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বাংলাদেশের জিডিপি ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশে উন্নীত হয়, যা আজও রেকর্ড । কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক ও আধা গণতন্ত্রী শাসকেরা স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতার অংশীদার করে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে দেশ শাসন করে। তাদের আমলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কখনোই ৪ থেকে ৫ শতাংশের ওপরে ওঠেনি। কিন্তু আমরা যদি ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনার সময়কে বিবেচনায় নিই, তাহলে কী দেখতে পাই? বঙ্গবন্ধুর পরে অর্থনীতি, উন্নয়নসহ সব ক্ষেত্রকে তিনি ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। দেশকে পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়।
পরিশেষে বলতে চাই, গত সাড়ে ১৩ বছরে যারা শেখ হাসিনাকে প্রত্যক্ষ করেছেন তারা এ কথা অস্বীকার করতে পারবেন না যে নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছেন। তার নেতৃত্বের গুণাবলি শুধু দেশের জনগণের মধ্যে প্রশংসিত হয়নি বরং তার নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছেন বিশ্ব দরবারে। বাংলাদেশের নেতা থেকে তিনি বিশ্ব নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দেশের ভেতরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জলবায়ু পরিবর্তন ও নারীর ক্ষমতায়নসহ অন্যান্য বিষয়ে তিনি সব সময় সরব থেকেছেন বিধায় আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বড় বড় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা তার কাজের প্রশংসা করেছেন।
এমনকি তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেতারা প্রশংসা করেছেন। কোভিড-১৯ মোকাবেলা করার কারণেও সরকারের সফলতা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তার এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন গত সাড়ে ১৩ বছর। আর আমাদের বাংলাদেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের আজকের যে অবস্থান সেটা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে তার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে। তবে তার এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করেছে সরকারের ধারাবাহিকতা, কারণ বাংলাদেশের মতো দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের জনগণ তার ওপরে আস্থা রেখে তাকে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবার সুযোগ করে দিয়েছে। কেবলই ১০০টি মহাসড়ক নয়, এটি শেখ হাসিনার সততা ও সাহসিকতার প্রতীক। এর আগে গত ৭ নভেম্বর গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে দেশের ২৫টি জেলায় নবনির্মিত ১০০টি সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্বাধীনতার এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে দেশ আজ বিশ্বদরবারে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের কারণেই। আমরা ভাগ্যবান জাতি কারণ আমাদের একজন শেখ হাসিনা আছেন। তিনি জানেন কীভাবে সংকটকেও সম্ভাবনায় রূপ দিতে হয়। দেশ ও মানুষকে নিয়ে এগিয়ে চলা যায়।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অব.), সাবেক সচিব, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এবং অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
ইএইচ