স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হলেও স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা জনসমক্ষে আসেনি। সমন্বয়হীনতার কারণে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজ এগোচ্ছে না।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বলছেন, রাজাকারদের তালিকা তৈরিতে কোনো গবেষক বিশেষজ্ঞদের রাখা হয়নি। আমলাদের দিয়ে করানো হচ্ছে এই তালিকা। তাই রাজনীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় রাজাকারদের তালিকা তৈরিতে জটিলতা দেখা দিয়েছে। রাজাকারদের তালিকার আইনি রূপ দিতে ২০০২ সালের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইনে সংশোধনী আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এরপর তালিকা প্রকাশে গড়িমসি সত্যিই দুঃখজনক।
২০১৯ সালের বিজয় দিবসের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী ১০ হাজার ৭৮৯ জন ‘স্বাধীনতাবিরোধীর’ তালিকা প্রকাশ করেন। ওই তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের নাম আসায় ক্ষোভ আর সমালোচনার প্রেক্ষাপটে সংশোধনের জন্য তালিকাটি স্থগিত করা হয়।
গত বছরের আগস্ট মাসে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইনের সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস করেছে সরকার। এতে রাজাকারের তালিকা তৈরির ক্ষমতা দেয়া হয় জামুকাকে। এরপরও জামুকা তাকিয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির দিকে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব। এক রক্তঝরা অধ্যায়। স্বাধীনতা লাভের পরপরই যুদ্ধাপরাধী, রাজাকারসহ এদের তালিকা চূড়ান্ত করা যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু সেটি করতে না পারার ব্যর্থতায় বাঙালি জাতিকে এখনো মূল্য দিতে হচ্ছে নানাভাবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলন ও শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও উচ্চারিত হয়েছিল রাজাকারদের তালিকার দাবিটি। আমরা এ তালিকা প্রকাশে আলোর মুখ দেখতে চাই। জানা গেছে, একাত্তরের মে মাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা দিতে গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী। খুলনায় খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন পাকিস্তানপন্থি কর্মী নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। পরে দেশের অন্যান্য অংশেও গড়ে তোলা হয় এই বাহিনী।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জারি করা এক অধ্যাদেশ বলে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়। এর সংখ্যা ছিল অন্তত ৫০ হাজার। শাহ আজিজ, গোলাম আযম, সবুর খান, আয়েনউদ্দিনসহ ইসলামী দলগুলোর নেতারা রাজাকার বাহিনীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তবে সবকিছুর পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনী এবং তাদের জেনারেলরা সরাসরি রাজাকার বাহিনী তৈরি করেছিল। রাজাকার ছাড়াও স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর, আলশামস এবং শান্তি কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন ছিল। বাকি সংগঠনগুলোর সদস্যদের তালিকাও পর্যায়ক্রমে প্রকাশের উদ্যোগ রয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার যে প্রয়াস শুরু হয়, তার পূর্ণতা পেতে রাজাকারের তালিকা তৈরির কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। অসংখ্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তাদের তালিকা তৈরি করে প্রকাশ করলে এই জাতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে স্বাধীনতাবিরোধী কারা। তালিকা তৈরির পর এদের সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যানের ডাক দিতে হবে। তবে সতর্কও থাকতে হবে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ যেন বিতর্কমুক্ত হয়।
প্রকৃতই যারা পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছে অথবা মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল, তারাই যেন শুধু তালিকাভুক্ত হয়। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যাতে তালিকা তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে শতভাগ সততার পরিচয় দিতে হবে। রাজাকারের সন্তান, যারা তাদের বাবার মতো আজও মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবোধক রাখতে চায়, তাদেরই চিহ্নিত করতে হবে আজ।
লেখক: সাংবাদিক।
ইএইচ