এক. এ স্লিপিং বিউটি এমার্জিং ফ্রম মিস্টস অ্যান্ড ওয়াটার- চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর কথা অমূলক নয়। বিচিত্র বাংলাদেশ অপার সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি, যার লীলাবতী প্রাকৃতিক মাধুর্য ভ্রমণপিপাসু মানুষকে হাতছানি দিয়ে প্রতিনিয়ত ডাকে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ জড়িত। পর্যটন শিল্পের রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা। গভীর রাতে পর্যটকরা সৈকতে যাচ্ছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের কারণে তারা আশস্ত যে সমুদ্র সৈকতে কোনো সমস্যা নেই। যেকোনো সময় সৈকতে গেলে টুরিস্ট পুলিশ দেখা যায়। এটা পর্যটনের উন্নয়নের জন্য ভালো। পর্যটনের উন্নয়ন ও পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় টুরিস্ট পুলিশ সৈকত জুড়ে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছে যা টুরিস্ট পুলিশ হেডকোয়াটার্স থেকে সরাসরি মনিটরিং করছে। সৈকতে তাকালেই ট্যুরিস্ট পুলিশ দেখা যায়-এটি পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সেবার বিষয়টি টেকসই করেছে। তবে বেশ কিছু প্রশ্ন আমাদের ভাবিয়ে তুলছে-যা থেকে পরিত্রাণ জরুরি।
দুই. পর্যটনের উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা থাকা জরুরি। পর্যটনের উন্নয়নের জন্য চোখে পড়ার মতো এমন মহাপরিকল্পনা দরকার। পর্যটনের উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয়, পর্যটন কর্পোরেশন, ট্যুরিস্ট পুলিশ, পর্যটন বোর্ড-সকলের সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। খাদ্য, স্বাস্থ্য, বস্ত্র, স্থান, ডিজিটাল সিটি, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, ট্র্যাফিক, পরিবহণ সুবিধা-এসব কিছু একটা পর্যটন স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণে এবং গুণগতমান থাকা জরুরি। সারা দেশে টুরিস্ট স্পট বাড়ছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যটনকেন্দ্রিক হওয়া দরকার। হোটেল মালিককে লক্ষ্য রাখতে হবে কারা স্পা ব্যবসা করে। বাইরে থেকে তালাবদ্ধ অথচ সুড়ঙ্গ রুমে, গর্তের মধ্যে স্পা ব্যবসা চলছে। পর্যটককে হয়রানি করা হচ্ছে। সতর্ক না হলে ট্যুরিজম নষ্ট হবে। তবে স্পা সাইনবোর্ড নিয়ে পতিতাবৃত্তি চালাচ্ছে যারা তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। কিশোর গ্যাং ও ইভটিজিং চিরতরে বন্ধ করতে হবে। ছিনতাইকারী দেখা যায় খুব সকালে। পর্যটক আহত হলে পর্যটনের উন্নয়ন হবে না।
তিন. একজন পর্যটন ব্যবসায়ী বলেছিলেন, ‘আমি যখন আমাকে পর্যটক হিসাবে চিন্তা করব, তখন অন্যের সমস্যা বুঝতে পারবো। যে এলাকায় যাবো - পরিবারের নিরাপত্তা বা অর্থ নিয়ে ফিরে আসতে পারব কিনা। পুরা দেশ সৈকতের দিকে তাকিয়ে থাকে। টুরিস্ট পুলিশ আসার পর থেকে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া এবং নিরপরাধ বিচার পাচ্ছে তার রাজসাক্ষী আমরা। আমার সমস্ত শরীরে পর্যটকের টাকা। ২২ বছর ধরে পর্যটকের টাকায় আমার সংসার চলে। নিজেকে নিজের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। তাহলে পর্যটনের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হবে’। এই বোধ সবার মধ্যে থাকতে হবে। ১২০ কিলোমিটার বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত অথচ ১০-২০ কিলোমিটার ব্যবহৃত হচ্ছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সাব/ওয়াক-ওয়ে করতে হবে। শুঁটকি পল্লী সরাতে হবে। টমটম পর্যটককে নিয়ে টানাটানি করে। তাদের পছন্দমতো হোটেলে নিয়ে যায়। কমিশন পায় সেখানে। বিমানের ও ট্রেনের টিকিট - বড় সমস্যা। কারসাজি করে হঠাৎ বিমানের টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি থামাতে হবে। মেরিন ড্রাইভ নিয়ে মহাপরিকল্পনা হতে পারে। সেন্টমার্টিনের মতো সোনাদিয়া দ্বীপ গুরুত্বের সাথে নেয়া দরকার। পরিকল্পনা মাফিক সোনাদিয়া দ্বীপকে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
চার. কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত টোকাই মুক্ত করা দরকার। পর্যটক বাড়লে হোটেল ভাড়া বেড়ে যায়। বিদেশি পর্যটক নিয়ে ভাবতে হবে। বিদেশি পর্যটক আনার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। ৬৩ জেলার পর্যটকের টাকায় কক্সবাজারের পর্যটন চলে। চার লেনের মহাসড়ক না হলে পর্যটক নিরাপদে আসতে পারবে না। পর্যটকদের মেহমানদারি করার জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মানসিকতা থাকতে হবে। কিছু হোটেল মালিক দালাল রাখে যা টেকসই পর্যটনের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফুটপাথ দখল হয়ে যায় স্থানীয় রাজনীতির কারণে। ফুটপাথ অবমুক্ত করতে হবে। টুরিজমকে বাড়ানোর জন্য মেরিন ড্রাইভকে ব্যবহার করতে হবে। আমরা পর্যটনবান্ধব হয়নি বলে ঐ এলাকাগুলোকে রাত্রিকালীন সময়ে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ স্থান হিসাবে তৈরি করা যায়নি।
পাঁচ. পর্যটন এলাকায় নিরাপত্তা সবচেয়ে দামি জিনিস। নাই এর মধ্যেও অনেক ভালো বিষয় রয়েছে কক্সবাজারে। পরিকল্পিত ট্র্যাফিক ব্যবস্থা রয়েছে সৈকত এলাকায়। সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত কৌশলে পরিকল্পনা করতে হবে। সিসি ক্যামেরা বাড়াতে হবে, সার্ভেইল্যান্স বাড়াতে হবে। রাস্তার দুইপাশে ভ্রাম্যমাণ অবৈধ হকার উচ্ছেদ করা জরুরি। সমুদ্রের মধ্যে লেজার শো হতে পারে। বিনিয়োগের নিশ্চয়তা দরকার। চেঞ্জিং রুম, শাওয়ার, ড্রেন নাই। কখনো নোংরা ও দুর্গন্ধ লক্ষ্য করা যায় সৈকতে । কক্সবাজারে আইকনিক রেল স্টেশন চালু হয়েছে। ব্রিজ হচ্ছে, পর্যটনের প্রসার হবে। আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট চালু হয়েছে। বিদেশি পর্যটক আসবে। আমাদের সেবা দেয়ার মানসিকতা তৈরি করে দেবে কে?
ছয়. নেপালের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, টুরিস্ট হলো তাদের কাছে ভগবানের মতো। নেপালের মতো প্রশিক্ষণ দরকার। আন্তরিকতা দরকার। কক্সবাজারে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রিফিউজি ক্যাম্প রয়েছে। এটি পর্যটনের জন্য আশঙ্কাজনক। রোহিঙ্গা সমস্যা পর্যটনের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাধান জরুরি। ইদানীং ভাসমান নারী সৈকতে ঘুরে বেড়ায়। ভীতিকর ও অসামাজিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাবার আগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। হোটেলগুলোর চেক-আউট ১১.০০ টায়। অধিকাংশের ফিরতি বাস রাতে। পর্যটক কোথায় যাবে? লাগেজ কোথায় রাখবে? সমুদ্রসৈকতে ভিজে গেলে গোসল করবে কোথায়? ভেজা কাপড় পরিবর্তন করবে কোথায়? শিশু থাকলে ফিডিং করবে কোথায়? পর্যটক হলেন অতিথি। অতিথিকে নারায়ণ মনে করতে হবে।
সাত. পিকনিক বাস, শিক্ষাসফরের বাস আসে। রিজার্ভ বাস আসে। ৩০টি বাস আসার পর বিশ্রাম নেয়ার ব্যবস্থা আছে। বাস ঢুকতে না দিলে পর্যটক আসবে না। নারী, শিশু লাগেজ নিয়ে অনেক দূর থেকে নগরীতে প্রবেশ করতে চাইবেন না। বাসগুলো পার্কিং করবে কোথায়? কক্সবাজারে ১১ হাজার টমটম, ২০০ ডলফিন গাড়ি রয়েছে। ইচ্ছামতো ভাড়া ধার্য করে তারা পর্যটকদের হয়রানি করে। নেপালের মতো চালক ও পরিবহণ শ্রমিকদের ব্যবহার হতে হবে। চালক ও পরিবহণ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। সমুদ্রসৈকতে চলা গাড়ি, মোটরসাইকেল, ঘোড়া, স্পিডবোট এক ধরনের ভাড়ার নৈরাজ্য তৈরি করেছে। এ থেকে পরিত্রাণ জরুরি। পর্যটক যত বাড়ে, খাবারের গুণগতমান তত কমে এবং দাম বেড়ে যায়। কক্সবাজারে লক্ষাধিক পর্যটক থাকলে খাবার পায়না। পর্যটন মৌসুমে স্থানীয়রা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করতে পারে। মন্টিনিগ্রোতে স্থানীয়রা খাবার তৈরি করে। অনেক সময় পর্যটক বেড়ে গেলে পঁচা ও বাসি খাবার পর্যটকদের দেয়া হয়। খেতে না পারলেও দাম নিয়ে নেয়া হয়। এসব বিষয় থেকে পরিত্রাণ জরুরি।
সেন্টমার্টিন ও ইনানি থেকে কেউ যাতে সামুদ্রিক কোরাল নিয়ে যেতে না পারে, সেটি দেখতে হবে। সেন্টমার্টিনে নজরদারি থাকলেও ইনানিতে নজরদারি নেই। সমুদ্রসৈকতে অনেক সময় মৃত ডলফিন, মাছ ও অন্যান্য প্রাণী পড়ে থাকতে দেখা যায় যা দ্রæত সরানোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। গত ১০-২৫ বছরে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত সংলগ্ন স্থানীয় জীববৈচিত্র্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে। ঝাউবন কেটে ফেলা হয়েছে। সমুদ্রসৈকত সংলগ্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের বাতি জ্বলে যা সামুদ্রিক প্রাণীর স্বাভাবিক জীবন-যাপন ব্যাহত করছে। সমুদ্রসৈকত সংলগ্ন অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট সীমানা পর্যন্ত কোনো স্থাপনা না থাকার ব্যবস্থা করা জরুরি। নতুন করতে না দেয়া এবং বর্তমানে থাকা স্থাপনাগুলো ভেঙে ফেলা জরুরি। হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট-এর কক্ষ, বারান্দা থেকে সৈকত দেখতে পাওয়ার আকর্ষণ তৈরি করতে গিয়ে আমরা অবলীলায় স্থানীয় জীববৈচিত্র্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে ফেলছি যা কেউ ভাবছি না। মেরিন ড্রাইভের সৈকতসংলগ্ন এলাকায় কোনো প্রকার যেন নতুন স্থাপনা তৈরি না হয় সে বিষয়ে কঠোর হস্তক্ষেপ নিতে হবে। রাতের বেলা সমুদ্রসৈকত সংলগ্ন অঞ্চলের স্থাপনাগুলোতে যেন অধিকমাত্রায় লাইটিং না থাকে এবং রাত ৭-৮ টার পরে কোনো উজ্জ্বল বাতি আর না জ্বলে সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি দরকার।
লেখক: ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।