দেশে জনসংখ্যার দিক থেকে নারীর সংখ্যা পরুষের চাইতে কম নয়, বরং বেশি। এতথ্য আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে নয়, সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১৬ লাখের বেশি নারী রয়েছে পুরুষের চাইতে। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জনশুমারির পর সরকার যে তথ্য দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৫১৬ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪, নারী ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন। হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ আছেন ১২৬২৯ জন। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন কল-কারখানায় কর্মজীবী নারীর সংখ্যা সেই অনুযায়ী খুবই কম। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নারী কর্মী নিতে চান না, আবার কোনো কোনো নারী ইচ্ছা ও প্রয়োজন থাকা সত্তে¡ও ঘরের বাইরে কর্মজীবী হতে চান না। কারণ, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানই নারীদের জন্য যথাযথ কর্মপরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। একথা সত্য যে অতীতের চাইতে এখন কর্মস্থালে নারীদের ঝুঁকি কমেছে, তবে এখনো সেটি শতভাগ নয়। কিন্তু বসে নেই নারীরা, তারা প্রতিক‚লতার মধ্যেই অগ্রসর হয়ে চলছে। দেশের সঙ্গে নিজেকেও এগিয়ে নিতে মোকাবেলা করছে নানা চ্যালেঞ্জ।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জি বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশের একটি প্রভাবশালী দৈনিকের সঙ্গে ২০২২ সালে কথা বলেছিলেন। তার ভাষ্য, নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি যদি পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখি, তাহলে আমি বলব, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভালো। আমি ২০১৬ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে এসেছিলাম, এখন ২০২২ সালের প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। এ সময়কালে বাংলাদেশের নারীরা অনেক এগিয়েছেন, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশ্চাদগমনও হয়েছে। বাংলাদেশে শ্রমবাজারের বিষয়ে বললে প্রথমেই তৈরি পোশাকশিল্পের কথা বলতে হয়। এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিকের ৬০ শতাংশই নারী। তবে একদিকে এ শিল্পের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে এখানে নারীর অংশগ্রহণ কিন্তু কমে আসছে। এর দুটি কারণ আছে। প্রথমটি হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে অনেক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হচ্ছে। ফলে সারা বিশ্বেই মোট শ্রমশক্তির চাহিদা কমে যাচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রির আকার বাড়ছে অনেকটা কর্মহীনভাবে বা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছাড়াই। একে আমরা বলছি, জবলেস গ্রোথ। এ ক্ষেত্রে শ্রমবাজারে নারীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বেশি। দ্বিতীয়ত, যেসব শিল্পকারখানার আধুনিকায়ন হচ্ছে, তৈরি পোশাক খাত তার মধ্যে অন্যতম। তাই নতুন প্রযুক্তির সঙ্গেও নারীকে খাপ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁর দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে।
কর্মজীবী নারীর জন্য অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে সামাজিক নিয়মনীতির রূপান্তর ঘটছে। নারীরা আয়মূলক কাজ করতে চান। কিন্তু ঢাকার বাইরে থেকে যখন কোনো নারী একাকী ঢাকা শহরে আসেন, তখন তাঁরা থাকার জন্য ভালো ও নিরাপদ জায়গা পান না। তা ছাড়া গণপরিবহন ব্যবস্থাও নারীবান্ধব নয়। এটাও শোনায যায় যে কোনো নারী একাকী থাকতে চাইলে বাড়ির মালিকেরা তাঁকে বাসা ভাড়া দিতে চান না। এই বাধা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে দেশকে।
১৯৯০ সালের পর থেকে দেশের শীর্ষপদে নারী। টানা সাড়ে ৩৪ বছরে দেশের নারীদের অনেক অগ্রগতি হয়েছে, এখনো যা হয়নি তা নিয়ে আমরা আশাবাদী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতা-বৈষম্যের সমীকরণের সঙ্গে যথার্থ ভারসাম্য রক্ষায় ইতোমধ্যেই আকাশচুম্বী অর্জিত হয়েছে দেশে। নারী নির্যাতন-নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নানামুখী অসংযত পর্যায় সমূহ সংহার করে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর উদ্যোগ সমধিক প্রশংসিত। দৃঢ় নেতৃত্ব-সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও প্রজ্ঞার অপূর্ব সম্মিলনে দেশের নারী সমাজের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে অনন্য নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। দল-সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন ও তৃণমূল পর্যন্ত অবিরাম নারী উন্নয়নের প্রসার ঘটিয়েছেন। নারী শিক্ষার বিকাশ-নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, নারী সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন এবং কর্মক্ষেত্র-রাজনীতিতে নারীর অবাধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ-বাস্তবায়নে চলছেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় প্রধান নারী, স্পিকার নারী, মন্ত্রিপরিষদে একাধিক নারী সদস্য, সংসদে সংরক্ষিত ৫০ আসন ছাড়া মাঠে প্রতিদ্বিি›দ্বতা করে একাধিক নারী সংসদে এসেছেন। উচ্ছপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান পরিচালনায়ও নারী দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। অনেক নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশি এভারেস্ট জয়ীদের মধ্যেও রয়েছেন নারী। আগে প্রশাসনের তৃণমূলে নারী সংখ্যা ছিলনা বলেই চলে, আর এখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। নারী উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক, পাশাপাশি এখনো নারীর জন্য যেসব প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান রয়েছে তা দূর করণে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।
মেহেরুন নিছা মেহেরীন, লেখক, সাংবাদিক।