বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বিপিএসসি) একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। কোটা আন্দোলন চলমান থাকাকালে পিএসসি কর্তৃক প্রশ্নফাঁসের গুরুতর অভিযোগ উঠে। যার ফলে প্রায় ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। বিগত কিছুদিনের অগ্নিঝড়া গণ অভ্যুত্থানের কারণে যেটা আপাত সময়ের জন্য হারিয়ে যায় সংবাদপত্রের পাতা থেকে।
এই পিএসসি বাংলাদেশে আলমাতন্ত্রের লোকবল সরবরাহ করে থাকে। বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের ২৬ টি পদ সহ অনেক ননক্যাডার পদে সুপারিশ করে থাকে পিএসসি। প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর বিভিন্ন পোস্টে মেধা যাচাই করে সবথেকে মেধাবী ও দক্ষ অফিসারদের নিয়োগ দেয়াই এই প্রতিষ্ঠানের কাজ। কিন্তু এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের পদে পদে দুর্নীতি এবং অদক্ষতা চোখে পড়ার মতো।
পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন অনেকবার এক বছরে একটি বিসিএসের কার্যক্রম শেষ করার উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন কিন্তু একটা বিসিএসও তিনি মোটামুটি চার (০৪) বছরের আগে শেষ করতে পারেননি। ৪৩ তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে কিন্তু তার যোগদান এখনো সম্পন্ন হয়নি। সেটার ননক্যাডার ফলাফল নিয়ে আবার একটি মামলা চলমান।
পিএসসি বিসিএসের সব পরীক্ষা স্তরে বিভিন্ন রকমের এক্সপেরিমেন্ট চালানোর পরেও এখনো বৈষম্যহীন এবং স্থায়ী কোনো কাঠামো দাড় করাতে পারেনি। বিসিএস ভাইভাতে কিছু সংস্কার আনলেও বৈষম্য দূর করতে পারেনি, যার ফলে বিসিএস ভাইভাতে মার্কস ২০০ থেকে কমানোর জন্য প্রার্থীদের মধ্যে আকঙ্খা তৈরি হয়েছে। পিএসসি চেয়ারম্যান বিসিএস থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ননক্যাডার নেয়ার প্রথা যে চালু হয়েছিলো সেটা বন্ধ করতে উদ্যত হয়েছেন, যার ফলে পিএসসি তে আরো পরীক্ষা ও ভাইবার জট সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি ননক্যাডার বিধিমালা প্রকাশে উদ্যোগ নিয়ে নিজেই সেই বিধিমালা ভেঙেছেন। তার উপর পিএসসি তে বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের বিভিন্ন সুপারিশ এবং ডিও লেটার পাঠানো ওপেন সিক্রেট। পিএসসির মানবিক এবং প্রার্থীবান্ধব রূপকে পরিবর্তন করে যেনতেন ভাবে দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রিলির সঠিক উত্তরপত্র প্রকাশ করা, নম্বরসহ র্যাংক প্রকাশ করা, ভাইভার আগে ক্যাডার চয়েজ লিস্ট পরিবর্তন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে হাতই দেয়নি পিএসসি যেগুলো প্রত্যেক প্রার্থীর চাওয়া। অতীত হয়ে যাওয়া স্বৈরাচারী সরকারের মতোই বর্তমান পিএসসি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সেটা প্রার্থী বান্ধব হবে কিনা সেটা নিয়ে ভাবেননি বা আলোচনা করেননি।
বর্তমানে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে বহুসংখ্যক প্রার্থী আন্দোলন না করলে পিএসসি প্রার্থীদের কোনো কথাই শুনতে রাজি নয় সেটা যতোই যুক্তিসংগত হোক না কেনো। কিন্তু পিএসসির সবথেকে বড় অভিযোগ হচ্ছে প্রশ্নফাঁস নিয়ে। এতোদিন থেকে পিএসসিতে প্রশ্নফাঁসের সিন্ডিকেট থাকলেও পিএসসি চেয়ারম্যান তা বন্ধে ব্যবস্থা নেননি অথবা একজন অযোগ্য চেয়ারম্যান হিসেবে প্রশ্নফাঁস তার নাকের ডগাতেই হচ্ছিলো সেটা বুঝতেই পারেননি। তার অধীনে অনুষ্ঠিত ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হয়েছে যা চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর এর একটি দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর বের হয়ে এসেছে। এর পর তিনি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও এখন পর্যন্ত কোনো রিপোর্টই প্রকাশিত হয়নি, ৪৬তম বিসিএসের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রার্থীরা এখনো সন্দিহান।
বর্তমান চেয়ারম্যান জেনে অথবা নিজের অজান্তে বিসিএস থেকে ননক্যাডার নিয়োগ অত্যন্ত কমিয়ে
এনে এই প্রশ্নফাঁস এবং পিএসসির অভ্যন্তরের অসাধু সিন্ডিকেটকে ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছেন। সংবাদ মাধ্যম ‘চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর’ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী পিএসসি কর্তৃক গৃহীত কমপক্ষে ৩০টি ননক্যাডার পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। বিসিএস থেকে ননক্যাডার নিয়োগ না দিয়ে আলাদা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নিয়োগ দিতে গেলে পিএসসি এর অতিরিক্ত সম্পদ, লোকবল, এবং সময় ব্যয় হবে। কিন্তু তারপরেও পিএসসি আলাদা বিজ্ঞপ্তি থেকে নিয়োগ দিতে এতো আগ্রহী কেনো সেটা ভেবে দেখা প্রয়োজন। আলাদা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ দেয়ার পর যদি অধিক দক্ষ অফিসার নিয়োগ করা যেতো তাহলেও এটা গ্রহণযোগ্য হতো। কিন্তু তর্কসাপেক্ষে বিসিএস থেকে নিয়োগ দিলেই সাধারণত অধিক স্মার্ট এবং মেধাবী প্রার্থীরা নিয়োগ পায়, এবং তারাই হয়ত আলাদা ভাবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ দিলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পাবে।
এই পিএসসি চেয়ারম্যান বিসিএস থেকে ননক্যাডার নিয়োগ কমিয়ে আনার পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। পিএসসি ৪৩তম বিসিএসে প্রথমবারের মতো গত ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের ২৬ তারিখে ক্যাডার এবং ননক্যাডার একসাথে নিয়োগ দিয়েছে যাতে মাত্র ৬৪২ জনকে ননক্যাডার হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছে। ননক্যাডার পদ বাড়িয়ে বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ক্যাডার, ননক্যাডার আলাদা ফলাফল প্রকাশ নিয়ে একটি রিট শুনানি চলমান হাইকোর্টে। এখানেও পিএসসির স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তথ্য অধিকার আইন – ২০০৯ অনুযায়ী প্রার্থীরা আবেদন করলে জানা যায় যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ৪৩তম বিসিএস থেকে ২৯২১টি শূন্য পদের অধিযাচন পিএসসি তে পাঠানো হয় কিন্তু পিএসসি মাত্র ৬৪২ টি পোস্টে সুপারিশ করে। বাকি পোস্টগুলোর কী হয়েছে সেটা নিয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর জানা যায়নি।
তার আগের ৪১তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশিত হয় ৭ই ডিসেম্বর ২০২৩, যেখানে ননক্যাডার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ৩১৬৪ জনকে।
৪০তম বিসিএসে ৩৬৫৭ জনকে ননক্যাডার পদগুলোতে সুপারিশ করা হয়। পিএসসি ধারাবাহিকভাবে
বিসিএস থেকে ননক্যাডার সুপারিশ করা কমিয়েছে এবং আলাদা পরীক্ষা নেয়া শুরু করেছে। আপরদিকে চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে নন ক্যাডারেই নিয়োগ বাণিজ্য রমরমা।
৪৪তম বিসিএসের ভাইভা চলমান, তাতে কতজন ননক্যাডার নিয়োগ দেয়া হবে সেটা নিয়ে কারো পরিষ্কার ধারণা আছে বলে মনে হয় না, আদৌ ননক্যাডার সুপারিশ করা হবে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন থাকে আসলে।
পিএসসি ৪৫ তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তির সাথেই ননক্যাডার পদের সংখ্যা উল্লেখ করে এবং চয়েজ লিস্ট নেয়।
তারপর আবার, ২০২৩ সালের জুনে পিএসসি ননক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধমালা, ২০২৩ প্রণয়ন করে। তার ৪নং ধারার নামই হলো ‘ননক্যাডার পদের বিবরণ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ’। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তির সাথেই নন ক্যাডার পদের সংখ্যা উল্লেখ থাকবে।
কিন্তু ৪৬ তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি যখন প্রকাশ হলো তখন দেখা যায় যে কোনো ননক্যাডার পোস্টের চাহিদা বিজ্ঞপ্তিতে দেয়া হয়নি। পিএসসি তাদের নিজেদের বিধিমালা এখানে ভঙ্গ করেছে নতুবা ৪৬তম বিসিএসে তারা ননক্যাডার সুপারিশ করবেন না।
বিপিএসসি এর বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইনের স্বেচ্ছাচারিতা, প্রশ্নফাঁস রোধে অযোগ্যতা, সময়মতো বিসিএস নিয়োগ দিতে না পারা এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পুরোনো গৌরবোজ্জ্বল দিন ফেরত নিয়ে আসার জন্য বর্তমান চেয়ারম্যানের পদত্যাগ/ পিএসসি থেকে তাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নাই।