একবিশংশ শতাব্দীর এই মোক্ষম সময়ে আমাদের শিশুদের সাথে বড়দের সখ্যতা বাড়ানোটা অনেক জরুরী। কতিপয় অনির্দিষ্ট ও অজানা কারণে বর্তমান প্রজন্মের সাথে প্রবীণদের যে অসামঞ্জস্যতা সেটি কি আসলেই আমলে নেয়ার প্রয়োজন আছে? আমাদের চারপাশে কেবল অভাবগ্রস্ত শিশুরাই নয় বরং বড় বড় অট্টালিকার চার দেয়ালের মাঝে বন্দী শিবিরে বেড়ে ওঠা অভিজাত শিশুদেরও অনেক না বলা কথা রয়েছে, সেটি অনুধাবন করবার জন্যই আজ এই আহ্বান! পুরো বাংলাদেশ জুড়ে প্রায় এক-চতুর্থাংশেরও বেশি শিশু রয়েছে, যাদের অনেকেই আজ নীরবে নিভৃতে নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে; শিশু অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে; এমনকি আধুনিক মা-বাবাদের অনেক বাড়াবাড়ি আচরনেও আজ তারা অনেকেই বাকরুদ্ধ সেজেছে!
ইউএনসিআরসি মতে মোট ৫৪টি ধারায় শিশুদের সার্বিক বিকাশ সাধনে যে সমস্ত বিধি নিষেধের কথা উল্লেখিত রয়েছে সে বিষয়ে আমরা কি আদৌ সেচ্চার? আজকের শিশু যদি আগামী দিনের সত্যিকারের গর্বিত হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে সর্বাগ্রে শিশুদের জন্য অনূকুল পরিবেশ প্রয়োজন! শিশুরা যাতে শারীরিক, মানসিক, আবেগীয় ও সামাজিক বিকাশ ঘটাতে কোনো রকম বাঁধার সম্মুখীন না হয় সে ব্যাপারে যেমন রাস্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে, অনুরুপ ঐকান্তিক দায়িত্ব রয়েছে মা-বাবার। শিশুদেরকে নির্মল পরিবেশে বাড়তে না দিলে তাঁর কাছে অদূর ভবিষ্যতে আমরা কি-ই বা আশা করতে পারি? খুব আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি যে, বর্তমান সমাজের আধুনিক অভিভাবকগণ জীবনে যে সমস্ত মনোবাসনা পূরণ করতে পারেননি, সন্তানদের দ্বারা সেটি বাস্তবায়নের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আজ তাঁরা নেমেছে দলবেঁধে। প্রতিটি পরীক্ষার ফলাফল ”এ” প্লাস না হলে যেন অভিভাবকত্বের মানহানি ঘটে!
উমুক্ত চিন্তার ছেলে-মেয়েদের মিলন মেলা, বাংলার মাটির সোঁদা গন্ধ, বাঙালী সংস্কৃতির চর্চা, সামাজিক আচার, পারিবারিক বন্ধন, এমনকি পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা সম্পর্কে এ যুগের “এ”প্লাস প্রাপ্ত শিশুরা খুব বেশি অবগত নয়। অধিকাংশ শিশুদের কাছে দাদুবাড়ীর মানুষেরা আজ বড্ড অচেনা। গাঁয়ের কাদামাখা মানুষদের সাথে মিশলে শিশুরা পথভ্রষ্ট হতে পারে ভেবে এ যুগের অনেক শিক্ষিত মায়েরা কখনোই গাঁয়ের আত্নীয়দের আদর-স্নেহকে প্রশ্রয় দিতে চান না। অনেক ক্ষেত্রে আদিখ্যেতা ভেবে এড়িয়েও চলেন বৈকি! বাড়ীর দুয়ারে গাছতলায় কিশোর-কিশোরীদের স্বাধীনভাবে চলার-বলার-খেলার তেমন অনুকুল পরিবেশই যেন খুব সীমিত আজকাল! তথাকথিত সভ্য-শিক্ষিত (পাষাণ) মা-বাবাদের একটাই লক্ষ্য-তাদের সন্তানদের ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে, মন না চাইলেও পড়তে হবে, ভাল রেজাল্ট করতে হবে,....!
অথচ শিশু অধিকার আইন-২০১৩ অনুযায়ী, শিশুর প্রতি রাস্ট্র ও অভিভাবকগণের যে দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেই হিসেবে, আমরা মা-বাবা-নিক আত্নীয় সহ শিক্ষকগণ ও রাস্ট্রের বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ কতখানি আন্তরিক বা সচেতন- সে বিষয়ে কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি? তাই এ ব্যাপারে প্রিয় পাঠকদেরও সুদৃষ্টি কামনা করছি! চোখের সামনেই শিশুর প্রতি অত্যাচারের ঘটনাগুলো দেখে বড্ড অসহায় লাগে! শিক্ষার মান উন্নয়নের নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে আজ ”শিক্ষক” নামক জাতির বিবেকগণ ! নীতি-প্রনেতাগণ চুপটি মেরে থাকবে কেন....? তারা তো প্রতি বছরই সিলেবাস পরিবর্তন করছেন, কোচিং বন্ধের ঘোষনা দিচ্ছেন। কালে-ভদ্রে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শন করছেন, শ্রেণীকক্ষে ডিজিটাল সামগ্রী অনুদান দিচ্ছেন, আরও কত কি....! পক্ষান্তরে, প্রাইভেট/ পাবলিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহ দ্রব্যমূল্য উর্ধ্বগতির সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতি বছর, বেতন বৃদ্ধি করছেন। একই শিক্ষক বিদ্যালয়ে সাধারন মানের শিক্ষাদান করেন, তারাই আবার প্রাইভেটে বা কোচিং বাণিজ্যে অ-সাধারন বণিক বনে যান। সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষকের যশ-খ্যাতির সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে মূহুর্তেই...। অতএব, এবার কোচিং বাণিজ্যে খদ্দের না হয়ে কি উপায় আছে...? কোচিং বিপননের চাহিদা এতটাই তুঙ্গে যে, আগে এলে আগে আসন বরাদ্দ পাবে, নয়ত....অকারনেই ভুল বলে বিবেচিত হবে অসহায় শিক্ষার্থীর পরীক্ষার উত্তরপত্রসমূহ!
অথচ, শিশু অধিকার সনদে প্রধান যে চারটি স্তম্ভ অর্থাৎ: ”বেঁচে থাকার অধিকার”, ”সুরক্ষার অধিকার”, ”উন্নয়নের অধিকার” এবং ”অংশগ্রহণের অধিকার” রয়েছে, সেগুলি মূলত: বৈষম্যহীন নীতির উপর ভিত্তি করে এবং সমস্ত কাজ অবশ্যই শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ রেখে মেনে চলার আহ্বান করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় তৎপরতায় ইতোমধ্যে নানামূখী পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে। শিক্ষকদের কিঞ্চিত বেতন বৃদ্ধিসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সরকারি তৎপরতা, ইত্যাদি। কিন্তু শিক্ষার্থীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে কমে যাচ্ছে! তবে কি এটি ফ্যামিলি প্ল্যানিং কর্মসূচির সু-প্রভাব....? যদি তা না হয় তবে সরকারের এই পদক্ষেপসমূহ আসলে কাদের জন্য ? পক্ষান্তরে, শহুরে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহে উপচে পড়া ভীড়....! অনেক টাকার বিনিময়ে হলেও ভর্তি করানো চাই-ই, চাই ! এসব লজ্জাকর প্রতিচ্ছবি দেখবার কি কেউই নেই?
বিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষের দিকে শিশুদের স্কুলে যাবার সময় ছিল সকাল ৯টা। সে সময়ে কেউ মাঝে-মাঝে স্কুল কামাই করলে প্রিয় শিক্ষক মহোদয়গণ খোঁজ নিতে বাড়িতে আসতেন। অভিভাবকগণকে তাঁদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর জন্য আহ্বান করতেন। তখন কেউ কেউ কালে-ভদ্রে পরিপাটি হয়ে স্কুলে যেত! বেশিরভাগ সময়ই গ্রামীন শিক্ষার্থীদের দল স্কুল পালিয়ে নানান রকম আনন্দে মেতে উঠতো । হা-ডু-ডু খেলতো, খালে-বিলে মাছ ধরতো, শাপলা ফুলের মালা গেঁথে দল বেঁধে বাড়ি ফিরতো, মা-বাবার বকুনি (কখনো কান মলানো) খাবার ভয়ে বিড়াল পায়ে দাদা-দাদীর ঘরে আশ্রয় নিতো। বিকেল বেলা আবারও সেই মিলনমেলায় জড়ো হতো সকলে এক সাথে! ছায়া-সুনিবিড়, নির্মল গ্রামগুলোতে বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি তখনো। তার পরেও সামাজিক মূল্যবোধের চর্চার ফলে সাাধারন মানুষের মনে একটা অলৌকিক আলোকছটা বিরাজ করতো। গাঁয়ের মানুষদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার কম ছিল বলেই জটিলতার মারপ্যাঁচও বুঝতো না। তবে কি জটিল হতে হলে বড়-বড় ডিগ্রী থাকতে হয়? একালের শিশুদের কাছে এসব পুরাতন কাসুন্দি ঘেঁটে আসলে কী কোনো লাভ আছে....? এসব মহা-শূণ্যতার সংলাপ শোনানোর কারণ হচ্ছে-এসব নিয়ে ভাববার মোক্ষম সময় এসে গেছে ঠিক এক্ষুণি!
এযুগের অনেক স্কুল শুরু হয় সকাল ৭টায় অথবা ৭টা.৩০ মিনিটে। কিন্তু উপস্থিত হতে হয় ঠিক ১৫ মিনিটের আগে। কতিপয় স্কুলের নিয়মটা এমন যে- ১৫ মিনিট আগে উপস্থিত হতে না পারলেই সেই শিক্ষার্থীকে আর স্কুলে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। দাঁড়োয়ানকে অনুরোধ করলেও কোন লাভ হয় না বরং কর্তৃপক্ষের নির্দেশানুযায়ী শিক্ষার্থীসহ অভিভাবককে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেয়া হয়! নামী-ধামী স্কুল বলে কথা! তবে কি এটাই শৃঙ্খলা আর শিষ্টাচার শেখানোর কৌশল! ৭ বছরের জনৈক ছেলেটি ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও রোজ ভোর ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে রোজ স্কুলে যায় (নয়তো জরিমানা মিলবে ও পরীক্ষায় নম্বর কম পাবে), ১১ টায় ফেরে আবার পোষাক পরিবর্তন করে কিছু খায় অথবা খেতে ইচ্ছেও করেনা, তাতে করো কিচ্ছু এসে যায় না। এবার অন্য আরেকটি স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নিতে হয়। যেহেতু সরকার কোচিং বাণিজ্য বন্ধের ঘোষনা দিয়েছে তাই কর্তৃপক্ষ ”স্কুলের” নাম ব্যবহার করে বহাল তবিয়তে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে; কিল খেয়ে কিল হজম করার মতো সুবোধ বালক ”স্কুল” নামক কোচিং সেন্টারের পোষাক গায়ে জড়িয়ে কর্তৃপক্ষকে ত্রুটিমুক্ত করতে তাদের স্বার্থে চোর সেজে নিজেকে উক্ত স্কুলের (আসলে কোচিং) ছাত্রের পরিচয় দিয়ে চলে দিনের পরে দিন! শিক্ষা অমূল্য সম্পদ- বলেই নিরপরাধ শিক্ষার্থীকে টাকার বিনিময়ে সকাল বেলা স্কুল নামক জেলখানায় যেতে হয় আর কর্তৃপক্ষের বাণিজ্যকে জমজমাট করতে দুপুর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্র নামক চোর সাজতে হয় ! বাড়িতে ফিরেই তাঁকে আবারও অধ্যয়নের প্রস্তুতি নিতে হয়। নয়তো হোম টিউটর এসে অগ্নি-মূর্তি ধারন করবে ! ঘুমে কাহিল হয়ে নেতিয়ে পড়া মাত্র সাত বছরের শিক্ষার্থীকে এ অত্যাচার সহ্য করতে হয় রাত ১১টা পর্যন্ত ! ক্ষিদের চেয়ে ঘুম যখন বেশি প্রয়োজন তখন তাকে জোর করে হলেও খেতে বাধ্য হতে হয়। সবশেষে ”শিক্ষক” হিসেবে কর্তৃত্ব ফলান জিপিএ হার বাড়ানোয় পটু এযুগের অতি সচেতন মা! এভাবেই চলতে থাকে সুন্দর শৈশব কেড়ে নেয়া হাজারো কোমলমতি শিশুর প্রতিদিন! আশি কিংবা নব্বই এর দশকের অনেক শিক্ষার্থী যেখানে একবেলায়ই নিয়মিত স্কুলে যেতো না আর এখনকার প্রজন্মের শিশুরা কিনা, রোজ নিয়মিত দু’বেলা যায় !
অতি স্মার্ট অভিভাবকরা হয়তো স্বপ্নের জাল বুনে এভাবে- আনন্দঘন মুহুর্তগুলো বিসর্জন দিয়ে একদিন নিশ্চয়ই তাদের সন্তান অনেক বড় অফিসার হবে...! সেদিনই সার্থক হবে জন্মদান ! তাঁরা অনেক বড় অফিসারই হবে বটে! তবে আশঙ্কা হলো মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেবে না তো? একদিকে বড় অফিসারের কর্তব্যপালনের ব্যস্ততা অন্যদিকে শৈশব কেড়ে নেবার প্রতিহিংসায় প্রজ্জ্বলিত, ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটাতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না স্বয়ং মা-বাবার প্রতি ! তাছাড়া চরম বাস্তবতার নিরিখে যে সন্তানকে কখনোই আবেগ স্পর্শ করেনি, তারা কেনই বা অ-হেতুক আবেগের মূল্য দিতে শিখবে.....?
হে জাতির বিবেকগণ, জিপিএ হার বাড়লেই কি জাতি এগিয়ে যাবে........? নাকি আজকের শিক্ষার্থীগণ মস্ত বড় অফিসার হলেই কি তবে মা-বাবার সার্থক হয়ে যাবেন? তাই উল্লিখিত বিষয়ে তবে জেগে উঠি সর্বাগ্রে শিশুদের ঐক্যের মিছিলে । তাদেরকে কেবল প্রাণী হিসেবে প্রতিদিন নির্যাতন না করে মানুষ হিসেবে বাঁচতে দেই। তাদের বর্ণিল শৈশব কেড়ে নিয়ে তাদের মনকে আর বিষিয়ে না তুলি, তারা সত্যিকারের মানুষ না হলে বরং দানব হয়ে ধূলিস্মাত করে দেবে আপনার, আমার, আমাদের জঞ্জাল সমাজটাকে.....!!!
লেখক : কলামিস্ট ও প্রধান শিক্ষক, চাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বগুড়া সদর, বগুড়া।